ভারতে করোনা বিপর্যয়, বিশ্ব বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব
এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতে করোনা মহামারির বিপর্যয় বিশ্ব বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
আজ মঙ্গলবার সিএনএন’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার বিধ্বংসী দ্বিতীয় ঢেউ শুধু ভারতের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলেনি, তা বিশ্বের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনার বিস্তার রোধে ভারত হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিনই সেখানে হাজার হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা চলতি বছরে ভারতে প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তা নিয়ে নতুনভাবে ভাবছেন। গত বছর ভারতজুড়ে লকডাউনের কারণে গত ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি।
করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী আবারও লকডাউন দেওয়ার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও বেশ কয়েকটি রাজ্য নিজেদের মতো করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ভারতের ওপর নির্ভরশীল বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। ভারতে সংকট আরও গভীর হলে বস্ত্রশিল্প, ওষুধশিল্প থেকে শুরু করে আর্থিক খাত ও বৈশ্বিক জাহাজ চলাচল ব্যবস্থাতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
সরবরাহ ব্যবস্থা
জাতিসংঘের ডব্লিউসিটিডি’র হিসাব মতে, বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য জাহাজে পরিবহন করা হয়। এসব জাহাজে ক্রু সদস্যদের অনেকে ভারতীয়।
আন্তর্জাতিক চেম্বার অব শিপিংয়ের তথ্য মতে, সারা বিশ্বের ১৭ লাখ জাহাজকর্মীর মধ্যে ভারতের রয়েছে দুই লাখ। তাদের অনেকেই রয়েছেন অফিসার পদে। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
আন্তর্জাতিক চেম্বার অব শিপিংয়ের মহাসচিব গাই প্ল্যাটেন সিএনএন’কে বলেছেন, ‘আমরা ভালো কিছুর আশা করছি। সমস্যার সমাধান হবে। তা না হলে সমুদ্রগামী ক্রুদের সংকট দেখা দেবে। এর ফলে, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
অনেক দেশ ভারত থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় ভারতীয় কর্মীরা অন্যান্য দেশের বন্দরগুলোতে যেতে পারছেন না।
বিশ্বের বৃহত্তম কন্টেইনার শিপিং কোম্পানি মার্সক’র হেড অব মেরিন রিলেশনস রেনে পিল পেডারসেন বলেন, আশা করি দেশগুলো সাধারণ ভ্রমণকারী ও জাহাজকর্মীদের মধ্যে পার্থক্য টানতে পারবে। তা না হলে এটি বৈশ্বিক কার্গো পরিসেবায় হুমকি সৃষ্টি করবে।
ক্রুরা জাহাজ থেকে বাড়ি ফিরতে না পারলে ‘মানবিক বিপর্যয়’ সৃষ্টি হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তার প্রতিষ্ঠানের ৩০ শতাংশ জাহাজকর্মী ভারতীয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ি ফিরতে না পারলে তাদের মানসিক শান্তি বিনষ্ট হবে।’
গত বছর মহামারির কারণে সমুদ্রবন্দর ও উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই লাখ জাহাজকর্মী কয়েক মাসের জন্যে নানাস্থানে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। সেসময় বিশ্বব্যাপী জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমানে ভারতে করোনা বিপর্যয়ের কারণে সেই অবস্থা আবার সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পেডারসেন।
ইতোমধ্যে জাহাজ চলাচলে বিলম্ব হচ্ছে বলেও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতের শিপিং লজিস্টিক কোম্পানি জিএসি’র ব্যবস্থাপক শঙ্কর নারায়ণান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, হংকং ও চীনসহ কয়েকটি দেশ ভারত থেকে আসা জাহাজগুলোকে কঠোর কোয়ারেন্টিনে রেখেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাহাজকর্মীদের ভ্যাকসিন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন বলেও মনে করছেন তারা।
ভ্যাকসিন সমস্যা
ভারতে করোনা বিপর্যয়ের কারণে ইতোমধ্যে অন্যান্য দেশেও টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে বিশ্বের ৬০ শতাংশের বেশি টিকা উৎপাদন করা হয়।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। গত বছর ২০ কোটি টিকা উৎপাদন ও ৯২টি দেশে তা রপ্তানির বিষয়ে রাজি হয়েছিল সেরাম। কিন্তু, এখন পর্যন্ত ভারতে মাত্র দুই শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাই সেখানে আগে টিকার দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সিএনএন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে করোনা সংক্রমণ দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ভ্যাকসিনের স্বল্পতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ওষুধশিল্পে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
কেননা, ভারত বিশ্বে জেনেরিক ওষুধের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী। অর্থাৎ, একই কার্যক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ কম খরচে ভারতে উৎপাদন করা হয়।
বস্ত্রশিল্প
বস্ত্রখাতে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় রপ্তানিকারক দেশ। করোনার কারণে শ্রমিক সংকটে পড়ে এই খাতটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাঞ্জাবের এনজি অ্যাপারেলস’র কর্মকর্তা অর্পিত আরিয়ান গুপ্ত গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই প্রথম আমাদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্যে আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।’
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়াজির অ্যাডভাইজরস’র মতে, করোনা সংক্রমণের কারণে দিল্লি ও বেঙ্গালুরুর পোশাক কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
গত বছর ভারতের বাজারে কাপড় বিক্রি ৩০ শতাংশ ও রপ্তানি ২৪ শতাংশ কমেছে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ‘২০২১ সালে কী হবে এখন এর পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। কেননা, আমরা জানি না মহামারি কবে শেষ হবে।’
আর্থিক সেবাখাত
বড় বড় ব্যাংক ও অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে কাজ টিকিয়ে রাখলেও এখন তারা বুঝতে পারছে ‘ব্যাক অফিস’ হিসেবে ভারতের গুরুত্ব কত ব্যাপক।
অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষিত শ্রমিক ও সস্তা শ্রমের কারণে ভারত থেকে তাদের আউটসোর্সিং করে। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়ার অ্যান্ড সার্ভিস কোম্পানিজ’র তথ্য মতে, ভারতের প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ আইটি ও ব্যবসা ব্যবস্থাপনা খাতে কাজ করছেন।
করোনা মোকাবিলায় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করা ও কাজ জমা দেওয়ার সময় বাড়ানোর পাশাপাশি ভারত থেকে অন্য দেশে কাজ সরিয়ে নিচ্ছে।
ভারতে কর্মীদের ওপর চাপ কমাতে যুক্তরাজ্যের বার্কলে ব্যাংক, ন্যাটওয়েস্ট ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড তাদের আউটসোর্সিংয়ের কাজ সে দেশ থেকে সরিয়ে অন্য দেশে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, ভারতে তাদের অনেক কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
Comments