ঢাকা বিভাগের ৭ জেলায় লকডাউন: ঘোষণায় কঠোর বাস্তবে শিথিল

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় রাজধানী ঢাকাকে সুরক্ষিত করতে চাইছে সরকার। সেই লক্ষ্যে ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলায় কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যাতে দেশের অন্য অংশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। রাজধানীতে লকডাউন দেওয়ার বিকল্প হিসেবেই সরকার এটা করেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
মাওয়ার গতকালের চিত্র। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/স্টার

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় রাজধানী ঢাকাকে সুরক্ষিত করতে চাইছে সরকার। সেই লক্ষ্যে ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলায় কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যাতে দেশের অন্য অংশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। রাজধানীতে লকডাউন দেওয়ার বিকল্প হিসেবেই সরকার এটা করেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সূত্র গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ থাকা বর্তমান বিধি-নিষেধের সময়সীমাকে বাড়ানোর পরিকল্পনাও করছে সরকার।

ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার এই সিদ্ধান্তটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে আগামী দিনগুলোতে করোনাভাইরাসের বিধি-নিষেধের শিথিলের কারণে দেশজুড়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘ভারতের মতো একই অবস্থায় আছে’ বলেও মন্তব্য করেন।

গতকাল উল্লেখিত সাতটি জেলার বিভিন্ন অংশে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদক দেখতে পান, সর্বত্র বেশ শিথিলভাবে ‘লকডাউন’ চলছে।

বেশিরভাগ দোকানই খোলা ছিল। বাসগুলো ডিপোতে রাখা থাকলেও সারা রাস্তাজুড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো ছোট যানবাহনগুলোকে যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে।

কয়েকটি জেলায় যানবাহনগুলোকে ট্রাফিক জ্যামেও আটকে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরি পথে হাজারো যাত্রীকে পদ্মা নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে যেতে দেখা গেছে।

এসব কিছুই হচ্ছে যখন সারাদেশে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে আরও ৮৫ জনের মৃত্যুর সংবাদ জানিয়েছে। এটি প্রায় দুই মাসের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা। এর আগে সর্বোচ্চ ৮৮ জন মারা গেছেন গত ২৯ এপ্রিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৮টার আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে পাঁচ হাজার ৭২৭ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

গতকাল সংক্রমণের হার বেড়ে গিয়ে ২০ দশমিক ২৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এই হারটি গত ৭১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সরকার জনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরকে কোভিড সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাত জেলার বিধি-নিষেধকে আরও কঠিনভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, সরকার এখনই রাজধানী শহরকে লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসার কথা বিবেচনা করছে না।

কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করছে এবং এটি নিশ্চিত করতে চাইছে যে উল্লেখিত সাত জেলায় কেউ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যাতে বাসা থেকে বের না হয়।

যানবাহনের চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে এবং কেউ জেলাগুলোতে ঢুকতে বা সেখান থেকে বের হতে পারবেন না, জানিয়েছে সূত্র।

বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে বলেছেন, সার্বিকভাবে সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা এবং দেশের অন্যসব জেলাকে কঠোর লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

ওষুধ ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘উচ্চ সংক্রমণের হারের কারণে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশকে লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। হাসপাতালে রোগীদের ভিড় কমানো এবং মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এটি আবশ্যক।’

তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত পরিস্থিতির বিষয়ে এখনো কেউ জানে না। কারণ, পর্যাপ্ত পরিমাণ কোভিড পরীক্ষা করা হচ্ছে না।’

অধ্যাপক রিদওয়ানুর সতর্ক করে বলেন, ‘দ্রুত কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সার্বিক পরিস্থিতি সম্প্রতি ভারতে যেরকম ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে, সেদিকে মোড় নিতে পারে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল দেশব্যাপী লকডাউনের পক্ষে মত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘অনেক বেশি সংখ্যক পরীক্ষা ও কোভিড আক্রান্ত রোগীদেরকে আইসোলেট না করা হলে লকডাউন ফলপ্রসূ হবে না। আমরা মহামারির শুরু থেকেই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে আসছি। পরীক্ষার সংখ্যা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম’, বলেন তিনি।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সিনিয়র অফিসিয়াল ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে জানান, সরকার রাজধানীতে লকডাউন দেওয়ার কথা এই মুহূর্তে ভাবছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বলেন, ‘বরং আমরা ঢাকার চারপাশের সাতটি জেলায় বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করছি।’

‘আমরা ঢাকার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। যদি পরিস্থিতির অবনতি হয়, তাহলে সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে’, বলেন তিনি।

কোভিড সংক্রমের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার সোমবার ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলা— মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জের সঙ্গে যাতায়াতের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে ঢাকাকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য।

মানুষ যাতে ঢাকা থেকে বের হতে বা ঢুকতে না পারে, সেজন্য সরকার পরের দিন সব ধরনের আন্তজেলা পরিবহনের মাধ্যমগুলোও (রেল, সড়ক ও নদীপথ) বন্ধ করে দেয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত জেলাগুলোকে লকডাউনের আওতায় নিয়ে এসেছি, যাতে রাজধানী শহরকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায়। ঢাকা এখন “হাফ-লকডাউন” অবস্থায় আছে।’

‘যদি ঢাকায় সংক্রমণের হার দ্রুত বেড়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা ঝামেলার হবে’, বলেন তিনি।

সারাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা বর্তমানে একই ধরনের বিধি-নিষেধের আওতায় আছে।

‘শিথিল লকডাউন’

বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও দেখা গেছে, গতকাল সারাদিন ধরেই গাজীপুর হয়ে মানুষ রাজধানীতে প্রবেশ করছে। বাসগুলো ডিপোতে পার্কিং করা থাকায় তারা রিকশা ও অটোরিকশায় করে যাতায়াত করেছেন, জানিয়েছেন আমাদের জেলা সংবাদদাতা।

এমনকি ঢাকা-গাজীপুর সড়কের বিভিন্ন জায়গায় যানবাহনের দীর্ঘ সারিও দেখা গেছে।

মুন্সিগঞ্জে হাজারো যাত্রী শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরি পথে পদ্মা নদী পার হয়েছেন।

সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী লঞ্চ ও স্পিডবোটের কার্যক্রম স্থগিত ছিল। কিন্তু, কিছু মালবহনকারী ফেরিতে ওঠার জন্যেও মানুষকে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়, জানিয়েছেন আমাদের জেলা সংবাদদাতা।

অনেকেই টার্মিনালে পৌঁছানোর জন্য গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করেন।

টার্মিনালে আদনান হোসেন নামে এক ব্যক্তি গতকাল দুপুরের দিকে জানান, ‘আমি সুদূর চাষাড়া (নারায়ণগঞ্জ) থেকে অটোরিকশায় করে এখানে এসেছি। আমাকে জরুরি কাজে বরিশাল যেতে হবে।’

নারায়ণগঞ্জে অনেক বিক্রেতা তাদের দোকানগুলো খোলা রেখেছেন। রাস্তায় বিপুল সংখ্যক রিকশা ও অটোরিকশা দেখা যায়। অনেকেই যানবাহন না পেয়ে হেঁটে তাদের গন্তব্যে গেছেন।

কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি অংশে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল হক জানান, পুলিশ যানবাহনগুলোকে মুন্সিগঞ্জের দিকে যেতে বাধা দেওয়ার কারণে এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

কুষ্টিয়াতে গত সোমবার থেকে সাত দিনব্যাপী লকডাউন চলছে। কিন্তু, মানুষ বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করছে না। কুষ্টিয়া শহরের রাস্তাঘাটে বেশিরভাগ মানুষকে মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।

সাতক্ষীরায় গত ১৯ দিন ধরে লকডাউন চলছে। তবে, রাস্তায় বিপুল সংখ্যক গাড়ি, মাইক্রোবাস, ইজি-বাইক ও মোটরসাইকেল চলছে।

টাঙ্গাইলের দুটি পৌরসভা লকডাউনের দ্বিতীয় দিনটি পার করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছিল। যানবাহনের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে বেনাপোল পৌরসভা, যশোরের শার্শা উপজেলা ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় নতুন করে সাত দিনের লকডাউন দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়াও, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন গতকাল সাতদিনের লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে, যেটি আগামী শনিবার থেকে শুরু হবে। আগামীকাল রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় নতুন করে সাতদিনের জন্য লকডাউন প্রযোজ্য হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Hilsa remains a luxury

Traders blame low supply for high price; not enough catch in rivers even after 2-month ban

30m ago