মানুষের জন্যে রাজনীতি করেছি, আমার সব সম্পদ মানুষের জন্যে: তোফায়েল আহমেদ

শুধু আওয়ামী লীগের নয়, তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের রাজনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ঘনিষ্ঠজন। কঠিন সময়ের আওয়ামী লীগের অন্যতম কাণ্ডারি। এই বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি জনমানুষের কল্যাণে দান করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেন বা কোন ভাবনা থেকে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? বিস্তারিত জানিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারকে।
তোফায়েল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

শুধু আওয়ামী লীগের নয়, তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের রাজনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ঘনিষ্ঠজন। কঠিন সময়ের আওয়ামী লীগের অন্যতম কাণ্ডারি। এই বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি জনমানুষের কল্যাণে দান করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেন বা কোন ভাবনা থেকে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? বিস্তারিত জানিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারকে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনার সব সম্পদ দান করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত কি হঠাৎ করেই নিয়েছেন?

তোফায়েল আহমেদ: না না, আমার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল যে আমার কিছু থাকবে না। আমি কোনো সম্পদ রাখব না। একটি ঘটনা বলি, যা আমাকে অনেকটা অনুপ্রাণিত করেছে এমন সিদ্ধান্ত নিতে। মহাবীর আলেকজান্ডার একদিন তার পাশে থাকা গুরুত্বপূর্ণদের ডেকে তিনটি নির্দেশ দিলেন। এক. আমি মারা গেলে আমার কফিন বহন করবেন চার জন ডাক্তার, যারা আমার চিকিৎসা করেছেন। দুই. আমি যত কিছু অর্জন করেছি, সোনাদানা-সম্পদ যা আছে তা বিলিয়ে দেবে। যেখান দিয়ে লাশ যাবে, সেখানে তা বিলিয়ে দেবে। তিন. কবরে নামানোর সময় হাত দুটি কফিনের দুই পাশে ঝুলতে থাকবে। জিজ্ঞাসা করবে এর কারণ কী? কারণ হলো- ডাক্তাররা মানুষকে চিকিৎসা করে সুস্থ করতে পারেন, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখতে পারেন না। আর যা অর্জন করেছি, তার কোনো মূল্য নেই। আমি খালি হাতে যাচ্ছি। শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছি। আমি কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না। এই যে কিছুই নিয়ে যাচ্ছেন না, আমিও তো শূন্য হাতে যাব।

ডেইলি স্টার: কিন্তু আপনার সন্তান…

তোফায়েল: আমার একটি মেয়ে আছে, সে ও তার জামাই বড় ডাক্তার। আর আমার বড় ভাই মারা যাওয়ার পর একটা ছেলে হয়েছিল, সে ছেলেটাকে আমি আমার ছেলে হিসেবে বড় করেছি। তারা কেউ আমার ওপর নির্ভরশীল না। এখন আমি, আমার স্ত্রী। আর আমার সব সম্পত্তি বলতে তত বেশি সম্পত্তি আমার নেই। বনানীর বাড়ি আর ভোলার বাড়ি। বনানীর বাড়ির জায়গাটা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীর নামে। আমার স্ত্রী এটা মেয়েকে দান করেছে। এখন মেয়ে ভোলায় একটি বড় হাসপাতাল করছে। এত টাকা পাবে কোথায়? প্রয়োজনে বনানীর বাড়িটা বিক্রি করে দেবে।

আর ভোলাতে আমার একটা সম্পত্তি আছে। বিক্রি করলে হয়তো ২০ কোটি টাকা পাব। ওটা কাগজপত্র ঠিক করে তোফায়েল আহমেদ ফাউন্ডেশনকে দিয়ে দিয়েছি। আমার ট্যাক্স দেওয়া নগদ কিছু টাকা আছে ব্যাংকে। এখান থেকে গরিব মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে।

ডেইলি স্টার: এখনো তো অনেককে সহায়তা করেন, মাঝেমধ্যে এমন সংবাদ জানা যায়।

তোফায়েল: তা তো করিই। নিজের ভালো লাগা থেকে করি, মানুষকে জানানোর জন্যে নয়।

ডেইলি স্টার: সহায়তা করেন কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায়?

তোফায়েল: একজন পঙ্গু লোক নামাজ পড়ছিলেন, তার গাড়িটা চুরি হয়ে গেছে। তার যে কান্না…। এক লাখ ৭৩ হাজার টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছি। আবার চ্যানেল আই রিপোর্ট করেছে, হবিগঞ্জের একটি মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে, আগুনে পুড়ে গেছে। মেয়েটা খুব ব্রিলিয়্যান্ট। তাকে এক লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এভাবে অনেক বাচ্চার নাম লিস্ট করে রেখেছি। মাসে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের অ্যাকাউন্টে অটোমেটিক চলে যায়। যেমন: একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে। তাকে পাওয়ার পর তার বাবা-মাকে চাকরি দিয়েছি। তাকে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছি এবং এখন মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা আমার অ্যাকাউন্ট থেকে ওই বাচ্চার অ্যাকাউন্টে চলে যায়। এভাবে মাসে পাঁচ হাজার, ১০ হাজার, ১৫ হাজার টাকা করে যায় বিভিন্ন জনের সহায়তায়।

আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব, আপনজনরা সাহায্য করে ফাউন্ডেশনে। ভোলায় আমার মায়ের নামে ফাতেমা খানম কমপ্লেক্স করেছি। ফাতেমা খানম হাইস্কুল, ডিগ্রি কলেজ, ফাতেমা খানম মা ও শিশু কল্যাণ, ফাতেমা খানম কেন্দ্র, স্বাধীনতা জাদুঘর, সবই আছে এই কমপ্লেক্সে। একটি সুন্দর বৃদ্ধাশ্রম করেছি। আধুনিক ব্যবস্থা রেখেছি। একটি রুমের মধ্যে আট জন থাকতে পারেন, এরকম ১০টি রুম, বিরাট ডাইনিং রুম। আমি যখন যাই, তাদের সঙ্গে খাই, আমার ছেলে দেখাশোনা করে। এসব আমার খুব ভালো লাগে। এসবই তো থেকে যাবে। সঙ্গে তো কিছুই নিয়ে যেতে পারব না।

ডেইলি স্টার: আপনি কি ইদানীং মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করছেন?

তোফায়েল: মানুষের ভেতরে মৃত্যু-চিন্তা খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে। আমার ভেতরেও আসে। যদিও মৃত্যু-চিন্তা থেকেই এসব করছি না। আমার বয়স এখন ৭৮। ইউপিএলের প্রকাশক গুণী মানুষ মহিউদ্দিন আহমেদ চলে গেলেন। তারও বয়স ছিল ৭৮। এখন আমি দেখছি যে ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০ বা ৮২ বছর বয়স, তারাই মারা যায় বেশি।

ডেইলি স্টার: আপনার ভেতরে কোনো হতাশা কাজ করে বা করছে?

তোফায়েল: আমি খুব স্যাটিসফায়েড একজন মানুষ। কারণ, আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আমার জীবন।

ডেইলি স্টার: আপনার সারা জীবনের যে রাজনীতি, এখন যে রাজনীতি দেখছেন, দুটো পর্যায়কে কীভাবে দেখেন?

তোফায়েল: নতুন করে কিছু বলার নেই, বলতেও চাই না। রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। আমি রাজনীতিবিদ দাবি করলেই তো হবে না। আমাকে একজন রাজনৈতিক কর্মী বলতে পারেন। আমি কোনো অন্যায় করিনি, অসৎ কোনো কাজ করিনি। আমি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম নয় বছর। এ দেশের ব্যবসায়ী সমাজ জানেন, সাহায্য করি নাই এমন কোনো লোক নেই। কারও থেকে কোনো সুবিধা নেইনি। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, আমি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্যে কঠিন করে দিয়ে যাব, তিনি কঠিন করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অরাজনীতিবিদরা সংসদে আসছে, ব্যবসায়ীরা আসছে। যদি সত্তরের নির্বাচনের কথা চিন্তা করি, টাকা নেই, পয়সা নেই। বঙ্গবন্ধু ঘুরছেন গ্রামে গ্রামে। আমি ভোলার অতি সাধারণ একজন মানুষ-রাজনৈতিক কর্মী, তাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করে, মানুষের ভালোবাসা আদায় করে নির্বাচনে জিতিয়ে এনেছেন। বঙ্গবন্ধু প্রকৃত রাজনীতিবিদদের বেছে বেছে মনোনয়ন দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর সময় আমরা যে ২৮৮টা প্রাদেশিক পরিষদের সিট পেয়েছি, ১৬৭টা এমএলএ হয়েছি, তার মধ্যে কে আছেন ব্যবসায়ী? এর মধ্যে ব্যবসায়ী কেউ থাকলেও তিনি পলিটিশিয়ানও ছিলেন। যেমন: রংপুরের মতিউর রহমান, তিনি ব্যবসায়ীও ছিলেন, পলিটিশিয়ানও ছিলেন। সুতরাং রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি চলে গেল ৭৫-এর পরে। আর কিছু বলতে চাই না।

আমি যেখানে বসে কথা বলছি, সামনে একটা ছবি আছে, ৯৬ সালে সরকার গঠন করার পরের। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মাঝখানে, তার পাশে জোহরা তাজউদ্দীন, তারপরে সাজেদা চৌধুরী, তারপরে আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কিবরিয়া সাহেব, সাদেক সাহেব, আমীর হোসেন আমু। তারপর আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ। মন্ত্রিসভার ছবির কথা বলছি। এমনি বললাম। এ বিষয়ে আর কোনো কথা নয়।

ডেইলি স্টার: আপনার সম্পদ দানের প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। মোট সম্পদ বা টাকার পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা দেবেন, যা দান করবেন?

তোফায়েল: আমার বেশি সম্পদ নেই। বিভিন্ন সময়ে কিছু জমি কেনা ছিল। ১৯৮৮ সালে আমি আমার ভায়রার সঙ্গে যৌথভাবে আদাবরে একটা জায়গা কিনি চার লাখ টাকা দিয়ে। জায়গাটা ডেভেলপারকে দিয়ে ১৮টা ফ্ল্যাট আমরা পাই, তারমধ্যে আমি পাই নয়টা। সেখান থেকে পাঁচটা বিক্রি করেছি আড়াই কোটি টাকায়। যা তোফায়েল আহমেদ ফাউন্ডেশনে যাবে। আর চারটা চার গরিব আত্মীয়কে দিয়েছি। দুই ভাগিনা, ভাতিজা। কালিয়াকৈরে নয় বিঘা জমি আছে। বিক্রি করলে হয়তো পাঁচ কোটি টাকা হবে। বিক্রি করে এই টাকাও ফাউন্ডেশনে দিয়ে দেব। রামপুরার দিকে দেড় বিঘা জমি আছে। একজনের কাছে ১৩ লাখ টাকা পেতাম। তার পরিবর্তে তিনি এই জমি দিয়েছিলেন। সেটাও বিক্রি করার চেষ্টা করছি। এই টাকাও ফাউন্ডেশনে যাবে।

পরিশেষে বলি, আমি সুস্থ আছি। মৃত্যুর চিন্তা থেকে এসব করছি না। আমি ভোলার সাধারণ একজন মানুষ। বঙ্গবন্ধুর কারণে আমি তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন মানুষের জন্যে করে গেছেন। সেই আদর্শ ধারণ করে আমিও সারাজীবন চেষ্টা করেছি। এখন যা আছে, তাও মানুষের জন্যে দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জীবনে সবকিছু পেয়েছি, আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই।

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

6h ago