আফগান যুদ্ধের দায় ৪ মার্কিন প্রেসিডেন্টের

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বারবার বলেছেন, তিনি আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রেসিডেন্টের হাতে দিয়ে যেতে চান না। এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো— ২০ বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধ তার হাতেও আসুক বাইডেন তা চাননি।
ছবি: রয়টার্স

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বারবার বলেছেন, তিনি আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রেসিডেন্টের হাতে দিয়ে যেতে চান না। এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো— ২০ বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধ তার হাতেও আসুক বাইডেন তা চাননি।

গতকাল সোমবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের আফগানিস্তানে অভিযান নিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। এই যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি সত্ত্বেও সেখানে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা ও তালেবানকে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি।

আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাইডেন বলেছেন, যে যুদ্ধের কোনো শেষ নেই তা বন্ধ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, তালেবানের সঙ্গে তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চুক্তির ভিত্তিতেই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়ো করে সরে আসা ও তালেবানের হাতে দেশটির নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রটির কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ ও হাজারও মানুষের মৃত্যু নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তালেবানের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে ২০ বছর যুদ্ধের পর সেখানে আবার তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কেন হলো তা আগামী কয়েক দশক ইতিহাসবিদদের আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।

আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধে দেশটির প্রেসিডেন্টদের ভূমিকা

জর্জ ডব্লিউ বুশ। ছবি: রয়টার্স

জর্জ ডব্লিউ বুশ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসবাদকে উপড়ে ফেলার ঘোষণা দেন। তিনি সেসময় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রক তালেবানকে সেখানে থাকা আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনসহ অন্য নেতাদের হস্তান্তরের আহ্বান জানান।

কিন্তু, তালেবান তা প্রত্যাখ্যান করলে বুশ যুদ্ধের পথ বেছে নেন। কংগ্রেস সদস্যরা আফগানিস্তানে অপরাধীদের ধরতে সেনা পাঠানোর অনুমোদন দিলেও তারা স্পষ্টত কখনোই যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষে ভোট দেননি বলে সিএনএনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন মতে, এরপর বুশ বলেছিলেন— 'আসন্ন সংঘাত আগের যেকোনো ঘটনার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে।' তবে তিনি ধারণাও করতে পারেনি যে তা কত দীর্ঘ হতে পারে।

এরপর, বুশ আফগানিস্তানে হাজার হাজার সেনা পাঠিয়েছেন। ২০০৩ সালের মে মাসে পেন্টাগন বলেছিল, আফগানিস্তানে বড় অভিযান শেষ হয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নিয়ে দেশ পুনর্গঠন এবং সেখানে তাদের ধাঁচে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করে।

আফগান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মার্কিনিদের হতাশ করে। এই প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে তালেবান আবার সেখানে শক্তিশালী হয়ে উঠে।

সেসময় ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। তখন তাদের মনোযোগ কাবুল থেকে সরে যায় বাগদাদের দিকে। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ যখন পুনর্নির্বাচিত হন, সেসময় আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার সংখ্যা ছিল ২০ হাজার।

আফগানিস্তানের দক্ষিণে গ্রামাঞ্চলে তালেবান শক্তিশালী হয়ে উঠলে দেশটিতে মার্কিন সেনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে বুশের ক্ষমতা ছাড়ার সময় সেখানে ৩০ হাজারের বেশি সেনা ছিল। সেই সঙ্গে তালেবানের পুরোদমে বিদেশি সেনা ও সরকারবিরোধী অভিযানও চলছিল।

বারাক ওবামা। ছবি: রয়টার্স

বারাক ওবামা

২০০৯ সালে হোয়াইট হাউসে আসার পর জর্জ বুশের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আফগান যুদ্ধ নিয়ে বিপাকে পড়েন বারাক ওবামা। তার শীর্ষ জেনারেলরা তালেবানকে দুর্বল করতে সেখানে সেনা সংখ্যা 'বাড়ানো'র পরামর্শ দেন। কিন্তু, তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর বিরোধিতা করেন।

তারপরও ওবামা প্রশাসন আফগানিস্তানে সেনা সংখ্যা বাড়াতে থাকে। সেসময় আফগান যুদ্ধ আবার তীব্র হয়ে উঠে। একই সময় ওবামা ঘোষণা দেন ২০১১ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা সরিয়ে নেওয়া হবে।

এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেছিলেন, অতিরিক্ত সৈন্য 'আফগানদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পরিবেশ তৈরিতে কাজ করবে।' পরবর্তীতে, ওবামার সহযোগীরা বলেছিলেন, সেনা কমান্ডাররা তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কৌশল গ্রহণের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

২০১০ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার সংখ্যা এক লাখে পৌঁছায়। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেন নিহত হলে প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা দেন— তিনি সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনবেন এবং ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানদের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ওবামা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে বড় অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। মার্কিন সেনারা তখন আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার কাজে মনোনিবেশ করে। ওবামার ক্ষমতা ছাড়ার আগেই সব সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

কিন্তু, তার ক্ষমতা ছাড়ার প্রাক্কালে দেখা যায় আফগানিস্তানে ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে সেনা প্রত্যাহার কোনো সুফল বয়ে আনবে না। তিনি যখন হোয়াইট হাউস ছাড়েন তখন আফগানিস্তানে সেনা সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের কম। সেসময় ওবামা বলেছিলেন, তার উত্তরসূরি ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তানের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সব সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু, তালেবান ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে ওঠায় তার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষার কাজ জটিল হয়ে পড়ে।

২০১৭ সালের আগস্টে ট্রাম্প স্বীকার করেন, তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির কারণে সেনা প্রত্যাহার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিনি তখন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা বেঁধে দিতে রাজি হননি। বলেন, 'পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে'।

এর এক বছর পর ট্রাম্প আফগান-আমেরিকান কূটনীতিক জালমে খলিলজাদকে তালেবানের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেন। সেই আলোচনায় আফগান সরকারকে তেমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

আলোচনার মধ্যেই তালেবান দেশটির রাজধানী কাবুলসহ নানা স্থানে হামলা চালাতে থাকে। এতে অনেক বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান।

অবশেষে, মার্কিন সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার ও তালেবানের হামলা কমানোর শর্তে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি চুক্তি সই হয়। কিন্তু, চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ তেমনভাবে দেখা যায়নি।

২০২১ সালের মে মাসে সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা মেনে চলার বিষয়টি শেষমেশ ট্রাম্পের উত্তরসূরির ওপর বর্তায়।

জো বাইডেন
জো বাইডেন। রয়টার্স ফাইল ছবি

জো বাইডেন

গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই জো বাইডেনকে আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলতে হয়। তিনি আফগান যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান।

ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি যখন সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তখন তা ওবামা প্রশাসন প্রত্যাখ্যান করেছিল। বাইডেন মনে করতেন, যে যুদ্ধের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই তা শেষ হওয়া উচিত।

ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি জানতে পারেন আফগানিস্তান থেকে সব সেনা সরিয়ে নিলে সেখানকার সরকারের পতনের পাশাপাশি তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে তিনি ঘোষণা দেন আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগে আফগানিস্তানে থাকা আড়াই হাজার সেনা সদস্যকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এ ঘোষণার পর পেন্টাগন দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু করে। গত ২ জুলাই তারা বাগরাম বিমান ঘাঁটি আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।

এ দিকে, তালেবান কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখল করতে থাকে। গত ১৫ আগস্ট তারা বিনা বাধায় কাবুল দখল করে নিলে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে চলে যান। সেই সঙ্গে পতন হয় আফগান সরকারের।

কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ছয় হাজার সেনা পাঠিয়েছেন বাইডেন। সেনা প্রত্যাহারের নতুন সময়সীমা ৩১ আগস্টের মধ্যে তাদেরকে আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। তালেবান বলেছে এটিই চূড়ান্ত সময়সীমা।

এখন বাইডেনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৩১ আগস্টের পর মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তানে রাখা হবে কিনা।

Comments

The Daily Star  | English

Where should I invest my money?

Amid persistently higher inflation in Bangladesh for more than a year, the low- and middle-income groups are struggling to meet their daily expenses.

12h ago