দেশে করোনার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে উদ্বেগ

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়ার কথা উঠে এসেছে একটি সমীক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
ছবি: এএফপি

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়ার কথা উঠে এসেছে একটি সমীক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।

গবেষকরা বলেছেন, ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার রোগীদের ওপর অনাবশ্যক আর্থিক চাপে ফেলছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) যৌথভাবে করোনাভাইরাসের জন্য ডেডিকেটেড পাঁচটি এবং সাধারণ পাঁচটি হাসপাতালে এই সমীক্ষা চালায়। হাসপাতালগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটে অবস্থিত। হাসপাতালগুলোর মধ্যে পাঁচটি সরকারি এবং পাঁচটি বেসরকারি।

এ বছরের ১ মে থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে 'অ্যান্টিবায়োটিক ইউসেজ অ্যান্ড অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিসট্যান্স ইন টারশিয়ারি কেয়ার হসপিটালস অব বাংলাদেশ' শীর্ষক সমীক্ষাটি চালানো হয়।

যেসব ওষুধ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে পরিচিত। এসব ওষুধ মানুষের রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সম্প্রতি অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহারের কারণে ব্যাকটেরিয়ার কিছু স্ট্রেইন তাদের ডিএনএতে সামান্য পরিবর্তন এনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী 'সুপারবাগে' রূপান্তরিত হয়েছে।

তারা জানান, প্রয়োজন না থাকার পরও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের কারণে মূলত এমনটা ঘটে।

অ্যাওয়ার (অ্যাক্সেস, ওয়াচ অ্যান্ড রিজার্ভ) শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। প্রাথমিক ব্যবহারের জন্য 'অ্যাক্সেস গ্রুপ'। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এর থেকে উচ্চ প্রতিরোধ গড়তে ব্যবহার করা হয় 'ওয়াচ গ্রুপ'। আর এই দুই গ্রুপের ওষুধ যখন আর কাজ করে না তখন ব্যবহার করা হয় 'রিজার্ভ গ্রুপ'।

২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব অ্যান্টিবায়োটিককে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করার জন্য অ্যাওয়ার শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতির প্রচলন করে।

আইইডিসিআরের সমীক্ষায় জানা গেছে, ডাক্তাররা প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্রে ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক দেন। অ্যাক্সেস গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক দেন ২৮ শতাংশ, শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ থাকে রিজার্ভ গ্রুপের এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেনি এরকম ওষুধ থাকে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।

এই গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জাকির হোসেন হাবিব বলেন, 'ডাক্তারদের ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সময় সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ এ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।'

সমীক্ষায় করোনা ওয়ার্ড ও আইসিইউতে থাকা রোগীদের ব্যবহারের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

দেখা যায়, পাঁচটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে চারটিতেই বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ডাক্তারদের প্রথম পছন্দের অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে সেফট্রিয়াক্সোন।

উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস হাসপাতালে ৬২ দশমিক ৮ শতাংশ রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দের ওষুধ ছিল সেফট্রিয়াক্সোন। এরপরে এসেছে অ্যামক্সিসিলিন ও ক্লাভুল্যানিক এসিডের নাম (২৪ দশমিক আট শতাংশ)।

একইভাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (৫৫ দশমিক আট শতাংশ), সিলেটের শহীদ সামসুদ্দীন হাসপাতাল (৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ), চট্টগ্রাম মেডিকাল কলেজ হাসপাতাল (৩০ দশমিক ৭ শতাংশ) এবং রাজধানীর উত্তরা আধুনিক মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে (২৭ দশমিক ৯ শতাংশ) করোনা রোগীর চিকিৎসায় সেফট্রিয়াক্সোন ছিল ডাক্তারদের প্রথম পছন্দ।

আইইডিসিআরের ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক সেফট্রিয়াক্সোন ই-কোলাই, প্রোটিয়াস এসপিপি, নন-টাইফয়েডাল স্যালমোনেল্লা ও এসাইনেটোব্যাক্টর কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী নয়।

সর্বশেষ সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, মেরোপেনেম নামের একটি ওয়াচ গ্রুপের ওষুধ এই পাঁচটি হাসপাতালে সর্বাধিক ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্যতম। এই ওষুধটি আইসিইউতে থাকা রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে।

ড. জাকির গত রোববার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোভিড-১৯ একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ এবং এ রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক উপযোগী নয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা না থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়।' করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে জানান তিনি।

'এছাড়াও (অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার) এটি রোগীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।'

সেফট্রিয়াক্সোন একটি দামী ওষুধ। এটিকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ঠিক নয়, উল্লেখ করেন ডা. জাকির।

অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ মেরোপেনেমকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ডাক্তারদের উচিত এই ওষুধটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়া এবং যতটুকু সম্ভব এর ব্যবহার এড়িয়ে চলা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন রোগীর নমুনার কালচার ও সেন্সিটিভিটি পরীক্ষা করেই কেবল তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ নির্ধারণ করা উচিত।

উদ্বেগজনকভাবে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় ওষুধ নির্বাচন করা হয়।

এই সমীক্ষার ফলাফলে গবেষকরা শুধুমাত্র কালচার ও সেন্সিটিভিটি পরীক্ষার ভিত্তিতে রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

তারা আরও জানান, সেফট্রিয়াক্সোন ব্যবহারে চিকিৎসকদের সতর্ক হওয়া উচিত।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

1d ago