ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ

২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয় অর্জিত হলেই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেই ভারতে আশ্রয় নেওয়া সব শরণার্থীকে সসম্মানে নিজ নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার খুব ভালো করেই জানে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সব সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দখলে নিয়েছে। তাই শত্রুসেনার কবলমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরণার্থীরা তাদের ন্যায্য মালিকানা ফিরে পাবেন।'

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেই ভারতে আশ্রয় নেওয়া সব শরণার্থীকে সসম্মানে নিজ নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার খুব ভালো করেই জানে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সব সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দখলে নিয়েছে। তাই শত্রুসেনার কবলমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরণার্থীরা তাদের ন্যায্য মালিকানা ফিরে পাবেন।'

২ সেপ্টেম্বর দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় 'গতকাল প্যারিস থেকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, ভারত পাকিস্তানি ভূ-খন্ডের কোনো অংশ দখলের চেষ্টা করলে পাকিস্তান পুরোপুরি যুদ্ধ করবে। দৈনিক লা ফিগারো পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে ভারত যদি মনে করে থাকে তারা বিনা উস্কানিতে আমাদের ভূখন্ডের কোনো অংশ দখল করতে পারবে, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবে। এর অর্থ হবে যুদ্ধ।'

তিনি বলেন, 'আমি বলতে পারি, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আমি এখনও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সীমান্ত পরিস্থিতি মোটেই শান্ত নয়। ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশ ও বিদ্রোহীদের উস্কানি অব্যাহত রয়েছে। এজন্যই উদ্বাস্তুরা বাড়িঘরে ফিরে আসতে পারছেন না । এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভারতীয়রা উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করছে। পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান এলাকা থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের কেন সরিয়ে রাখা হয়েছিল তা জিজ্ঞেস করলে জেনারেল ইয়াহিয়া তার জবাবে বলেন, 'আমি তাদের রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। এই ধরনের সামরিক অভিযান শুরু হলে তার পরিণাম কী হবে তা কেউ জানে না। আমি একজন সৈনিক হিসাবেই কাজ করছি, একজন আয়েশি রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়। পরে অবশ্য আমি এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছি। যদি কোন সাংবাদিক আওয়ামী লীগের হাতে নিহত হতেন, সেটা আমার খুবই কাজে আসত।'

ভারতে এদিন

২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, 'পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেখ মুজিব বেঁচে আছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত দূত হেনরি কিসিঞ্জার যখন ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন, তখন প্রথম ফারল্যান্ড ওই প্রস্তাব শেখ মুজিবকে পাঠান। দ্বিতীয়বার একই প্রস্তাব পাঠান চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। কিন্তু শেখ মুজিব বলেন, যাদের অস্ত্রে বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।'

২ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে কলকাতায় আসে ১৬ দেশের সামরিক বাহিনীর পর্যবেক্ষক দল। এই পর্যবেক্ষকেরা পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করবেন এবং শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করবেন।

এই দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপাইন, লেবানন, মিসর, ইরান, ঘানা প্রভৃতি।

২ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন পশ্চিম জার্মানির বিশেষ দূত এমপি গুয়েনভার রিনসাচি। এসময় তিনি বলেন, 'পূর্ব বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ। আমাদের সরকার শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। জার্মানি চায় শেখ মুজিবের মুক্তি দেওয়া হোক। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো কাজ যেন তিনি না করেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২ সেপ্টেম্বর নরওয়ের অসলোতে দেশটির প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী। এই বৈঠকে আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে পিয়ের অল্ডকে সব খুলে বলেন একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তানের বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিতে নরওয়ে সরকারের প্রতি অনুরোধ করেন। পিয়ের অল্ড বলেন, নরওয়ে সবসময়ই মানবতা ও জনগণের রায়ের পক্ষে।

এদিন বিকেলে আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। এরপর তিনি অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘৃণ্য গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে জানান। আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ট্রাইব্যুনালের প্রধান কাজ হবে গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রণয়ন করা।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২ সেপ্টেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি বন্দরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হারেস উদ্দিন সরকারে নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর শঠিবাড়ি বন্দর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের অবস্থানের ৬০০ গজের মধ্যে এগিয়ে এসে আক্রমণ শুরু করে।

২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার চালনা বাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৌকা দিয়ে চারদিকে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে এগিয়ে যায়। এসময় পূর্ব থেকে ওঁত পেতে ছিল মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের মধ্যে চলে এলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর তিনটি নৌকা পানিতে ডুবে যায় এবং বহু সৈন্য নিহত হয়। আক্রমণ শেষে হানাদার সেনারা আর্টিলারির সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আজাহার আলী শহীদ হন।

২ সেপ্টেম্বরে কুমিল্লার গজারিয়াতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল নারায়ণগঞ্জ-দাউদকান্দি সড়কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর হামলা চালায়। এসময় ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ৩ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং একজন বন্দি হয়। এসময় হানাদার গেরিলারা হানাদার ৫টি রাইফেল ও ১৫০ রাউন্ড গুলি দখল করে।

২ সেপ্টেম্বর সিলেটে মুক্তিবাহিনীর ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কোনাগ্রাম ও বিয়ানীবাজার এলাকায় অপারেশন চালায়। এই অপারেশনে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়।

২ সেপ্টেম্বর বগুড়ার গাবতলির জাতহলিদা গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুক্তিবাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে একজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা ৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Hilsa remains a luxury

Traders blame low supply for high price; not enough catch in rivers even after 2-month ban

1h ago