আত্মসমর্পণ করেও মুক্তি মেলেনি সুন্দরবনের ডাকাতদের

আত্মসমর্পণ করেও যেন মুক্তি মেলেনি সুন্দরবনের ডাকাতদের। বৈধ আয়ের একটি বড় অংশ ঢালতে হচ্ছে মামলার পেছনে।
মোস্তফা শেখ। ছবি: স্টার

আত্মসমর্পণ করেও যেন মুক্তি মেলেনি সুন্দরবনের ডাকাতদের। বৈধ আয়ের একটি বড় অংশ ঢালতে হচ্ছে মামলার পেছনে।

আত্মসমর্পণ করা ৩২৮ জনের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের একটাই দাবি—ডাকাতির কারণে দায়ের হওয়া মামলা থেকে যেন তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আজ সোমবার 'দস্যুমুক্ত সুন্দরবন দিবস' উপলক্ষে বাগেরহাটের রামপালে র‌্যাবের অনুষ্ঠানে আসা বিভিন্ন সময়ে আত্মসমর্পণ করা ডাকাতদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে এমন দাবির কথাই জানা যায়।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এক সময়ে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ বলেন, 'কখনো প্রতিপক্ষ আবার কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আতংকে দিন কাটতো। ছেলে, মেয়ে, বাবা, মায়ের মুখ দেখতে পারতাম না, গ্রামে আসতে পারতাম না।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতার কারণে আমার ১ যুগের ডাকাত জীবনের সমাপ্তি হয়। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলার কারণে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারছি না। পুলিশের আতঙ্ক আর মামলার ব্যয় বহন করতে গিয়ে আমাদের স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটানো অনেক কষ্টদায়ক হয়ে যাচ্ছে।'

মাস্টার বাহিনীর এই সাবেক প্রধান আরও বলেন, 'একটা সময় আমার এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে ডাকাতির জীবন বেছে নেই। ডাকাতির জীবনে আয় ভালো থাকলেও অজানা আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াত। আর এখন ডাকাতি ছেড়ে দেওয়ার পরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তের জীবন পেয়েছি। কিন্তু মামলার কারণে শুরু হয়েছে আরেক আতঙ্ক।'

'আত্মসমর্পণের সময় আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো ছিল সেগুলো ১ বছরের মধ্যে প্রত্যাহার করার কথা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু ৩ বছর পরে এসেও মামলার আসামি রয়েই গেলাম,' যোগ করেন তিনি।

মোস্তফা শেখ বলেন, 'সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দল ছিল আমার। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমার দলের ৯ সদস্য নিয়ে ৫২টি অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করি। দলের সবাই আত্মসমর্পণের সাহস করেনি। তবে আমরা আত্মসমর্পণ করার পর একে একে সবাই ডাকাতি ছেড়ে সাধারণ জীবনে ফিরে এসেছে।'

'ডাকাতি ছেড়ে ভালোই ছিলাম। নতুন জীবন পেয়ে একটি দোকান দিয়েছিলাম। কিন্তু মামলার কারণে এখন বাড়িতে থাকতে পারছি না। আমার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ওয়ারেন্ট রয়েছে। পালিয়ে বেড়ানোর কারণে দোকান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এখন আবার সেই আগের মতো পালানোর জীবন চলছে। সরকার আমাদের অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে। কিন্তু মামলা থেকে মুক্তি না দিলে আমাদের জীবনে সুখ ফিরবে না। এটা শুধু আমার কথা না, প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সারা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সবারই এই একটাই দাবি।'

ডাকাতি জীবন সমাপ্তির ৩ বছর পর কেমন আছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা শেখ বলেন, 'ভালো নেই তা বলবো না। তাহলে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু আমাদের প্রথম চাওয়া হলো মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এটা করবো।'

প্রায় ৮ বছর সুন্দরবনের বড় ভাই বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন মো. ইউনুস মোল্লা। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করার আগে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন প্রায় ২ শতাধিক অপহরণ।

দ্য ডেইলি স্টারকে ইউনুস জানান, তার নামে ৪টি মামলা রয়েছে। আত্মসমর্পণের পর যে নগদ অর্থ সহায়তা পেয়েছেন তা দিয়ে চাষাবাদ করে কষ্টার্জিত আয়ের সিংহভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে আইনি লড়াইয়ে।

এ বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে যারা খুন ও ধর্ষণ মামলার আসামি, তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই। বাকীদের মামলা নিষ্পত্তিতে আমরা আইনানুগ সহায়তা করবো।'

যারা খারাপ পথ থেকে ফিরে এসেছেন তাদের বুকে টেনে নিতে স্থানীয়দের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আইজিপি বলেন, 'তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়তা করুন।'

সুন্দরবনের নিরাপত্তায় দুটি ক্যাম্প রয়েছে, আরও ক্যাম্প দরকার জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে সুন্দরবনকে অশান্ত করা হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ের এ বন দস্যুমুক্ত হয়েছে।  অনেকেই এই প্রক্রিয়া ভন্ডুলের চেষ্টা করেছে।'

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র বিপর্যয়ের পেছনে সমন্বয়হীনতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'একটি জাতীয় পত্রিকায় দেখলাম লেখা হয়েছে বনে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে, পুলিশ কিছু করছে না। পুলিশের এখানে কিছু করার নেই। আমাদের পানি দেখেন একজন, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ বিভাগ দেখেন আরেকজন। আবার বন বিভাগও আলাদা। এ বিষয়গুলো সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।'

২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ৩২টি বাহিনীর ৩২৮ জন ডাকাত ৪৬২টি অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। তাদের মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

3h ago