সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে পাকিস্তানি বাহিনীর চরম নিষ্ঠুরতা!

‘নাৎসি বাহিনী’ শব্দদ্বয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বন্দি শিবিরগুলোতে ছড়িয়ে থাকা আতঙ্কের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী বিহারীরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাগুলোর মতোই ভয়াবহ।
saiyeedpur_1971_17dec21.jpg
সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে লোহা গলানোর জন্য ব্যবহৃত একটি বয়লার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেখানে বাঙালিসহ সব কর্মচারীকে নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: ইএএম আসাদুজ্জামান

'নাৎসি বাহিনী' শব্দদ্বয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বন্দি শিবিরগুলোতে ছড়িয়ে থাকা আতঙ্কের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী বিহারীরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাগুলোর মতোই ভয়াবহ।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা এই রেলওয়ে ওয়ার্কশপে কর্মরত অন্তত ১৭৭ জন বাঙালিসহ সব কর্মচারীকে হত্যা করে। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীদের লোহা গলানোর জন্য ব্যবহৃত বড় বয়লার ও চুল্লিতে নিক্ষেপ করা হয়। এ ছাড়া, কাউকে কাউকে ছুরি মেরে অথবা গুলি করে খুন করা হয়।

প্রখ্যাত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীকের মতে, 'নৃশংসতার বিচারে সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের ঘটনাটি ছিল নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত।'

ওই বর্বরতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে সেদিন বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তি বলেন, যুদ্ধের সময় সৈয়দপুরে বিহারীদের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বেশি ছিল।

১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি দেখতে পান কিছু বিহারী তাদের কয়েক জন বাঙালি সহকর্মীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মাটিতে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ওয়ার্কশপের সাবেক কর্মচারী ৬৯ বছরের সিয়াম দস্তগীর সে সময়ে স্মৃতি হাতড়ে বলেন, 'আমি তাদের চিৎকার শুনতে পাই। তারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। পরে জানলাম, তাদের সবাইকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বেঁচে থাকা অবস্থাতেই তাদের চুল্লিতে রাখা হয়েছিল।

এপ্রিলের শুরুর সপ্তাহে কয়েকজন বিহারী সিয়ামের বাবা আইয়ুব আলীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। যিনি নিজেও ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। সিয়াম জানান, এরপর থেকে তিনি তার বাবাকে আর দেখেননি।

মার্চের শুরুতে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম দানা বেধে উঠলে শিগগির তার ঢেউ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নীলফামারী জেলার শান্ত শহর সৈয়দপুরও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর অন্য বিভিন্ন জায়গার মতো সৈয়দপুরেও বাঙালিরা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। সেখানেও গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ।

সৈয়দপুরের উর্দুভাষী বিহারীদের বেশিরভাগ ১৯৪৭ এর দেশভাগের আগে এখানে আসে। তারা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। এখানকার মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, এমনকি 'পাকিস্তান রক্ষায়' বিহারীরাও একটি কমিটি গঠন করেছিল।

হাফিজুর রহমান 'মুক্তিযুদ্ধে রংপুর' নামে একটি বইয়ের সম্পাদকীয় কমিটিরও সদস্য, যেখানে ১৮৭০ সালে নির্মিত রেলওয়ে ওয়ার্কশপে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পাওয়া যায়।

হাফিজুর জানান, একাত্তরের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে বাঙালিরা ওয়ার্কশপে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। বিপরীতে বিহারীরা সেদিন সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেছিল।

ওই দিনেই বিহারীরা বাঙালিদের বিভিন্ন জায়গায় জিম্মি করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মাহতাব বেগের নেতৃত্বে প্রায় ৫ হাজার বাঙালি গ্রামবাসী দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলা থেকে সৈয়দপুর অভিমুখে মিছিল নিয়ে আসতে থাকে।

হাফিজুর রহমানসহ স্থানীয়দের ভাষ্য, এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে বেশ কয়েকজন বাঙালি নিহত হন। গুরুতর আহত হন মাহতাব। পরে কয়েকজন দালাল তাকে ছুরি মেরে হত্যা করে।

হাফিজুর রহমানের মতে, মূলত এই ঘটনার পর বিহারীরা আরও বেশি নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। ২৫ মার্চ রাতে সংঘটিত 'অপারেশন সার্চলাইট' সৈয়দপুরে বাঙালিদের ভয় আরও বাড়িয়ে দেয়।

২৬ মার্চ সন্ধ্যায় ওয়ার্কশপের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরের দিন সকালে কাজে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। জানানো হয়, এই নির্দেশনা না মানলে তাদের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।

ওয়ার্কশপের সাবেক কর্মী সিয়াম জানান, বাঙালি কর্মচারীরা ওই নির্দেশ মানতে বাধ্য হন।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত গবেষক সাজ্জাদ আলী জহিরের ভাষ্য, ২৭ মার্চ সকালে কিছু বিহারী ওয়ার্কশপের গেটে এম এ আজিজ নামে এক বাঙালি কর্মকর্তাকে হত্যা করে। তাকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে একইভাবে হত্যার শিকার হন আরও ৫ বাঙালি।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওয়ার্কশপে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় একাত্তরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে।

সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, 'এটা ছিল চরম নিষ্ঠুরতার ঘটনা। তারা (বিহারীরা) মানুষকে লোহা গলানোর জন্য রাখা ৩টি বড় বয়লার ও চুল্লিতে জীবন্ত নিক্ষেপ করতো। অনেক দূর থেকেও ভুক্তভোগীদের চিৎকার শোনা যেত।'

ঘাতক দলে ছিল মতিন হাশমী, মোহাম্মদ হাব্বু, মোহাম্মদ জাহিদ ও ওয়ার্কশপের অন্যান্য অবাঙালি কর্মীরা। সাজ্জাদ বলছিলেন, 'এই হৃদয়হীন খুনিদের প্রতি সৈয়দপুর সেনানিবাসে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল…ক্যান্টনমেন্টের নির্দেশ ও সহযোগিতা ছাড়া বিহারীরা কিছুই করেনি।'

লুৎফর রহমানের বাবা ওসমান গণিও ছিলেন ওই ওয়ার্কশপের কর্মী। লুৎফর স্পষ্ট মনে করতে পারেন যে, ৪ এপ্রিল তার বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে আর ফিরে আসেননি।

লুৎফর বলেন, 'পরে আমরা বাবার সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারি যে বিহারী কর্মচারীরা তাকে চুল্লিতে ফেলে মেরেছে। তিনি কান্নাকাটি করলেও খুনিরা তার প্রতি কোনো দয়া দেখায়নি।'

আলাপকালে সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক জইদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তারা একাত্তরে নিহত ১৭৭ জন কর্মচারীর একটি তালিকা তৈরি করেছেন। যাদের বেশিরভাগকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

ওয়ার্কশপ কর্তৃপক্ষ নিহতদের সম্মান জানাতে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছে।

শহীদদের মধ্যে আছেন মর্তুজা আলী, অমৃতা মণ্ডল, আবদুল গফুর, রাম চন্দ্র রায়, অমীয় ভূষণ, কালা মিয়া, হাশমতউল্লাহ, মো. সিদ্দিক, শেখ মাহতাবউদ্দীন, আরফান মিয়া ও বশিরউদ্দিন।

সাজ্জাদ আলী জহিরের মতে, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা নজিরবিহীন যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছিল। ফলে নিহত হয়েছিল এত নিরপরাধ মানুষ।

তিনি বলেন, 'আমাদের অবশ্যই সেসব হত্যাকাণ্ডের রেকর্ড রাখতে হবে। এটা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, নিজস্ব একটি দেশ পেতে বাঙালিদের কতটা মূল্য দিতে হয়েছে, তা নতুন প্রজন্মের জানা উচিত।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

April saw lowest rainfall in Bangladesh

Average rainfall in Bangladesh was one millimetre in April, which is the record lowest in the country since 1981

29m ago