ইউএনও-এসি ল্যান্ডের অনুমোদনে আবাদি জমি হয়ে যাচ্ছে পুকুর

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার ডাকমাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল বাছেদ তার আবাদি জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের জন্য আবেদন করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার-ভূমির (এসি-ল্যান্ড) কাছে। জামনগর ইউনিয়নের ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. বদরুজ্জামান ওই জমির বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেন এসি-ল্যান্ড নিশাত আনজুম অনন্যাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি রেকর্ডে ধান আবাদের জমি, কিন্তু বাস্তবে জলাবদ্ধ। ওই জমি পুকুর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এমন তথ্য প্রতিবেদনে ছিল না। কিন্তু পুকুর হিসেবে আব্দুল বাছেদের কাছ থেকে ৯ বছরের খাজনা নিয়েছেন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান। পরবর্তীতে বাছেদ আলী সংস্কারের নামে আবাদি জমিটিতে পুকুর খনন করছেন।
একই উপজেলার একডালা গ্রামের অপর কৃষক মো. সজল হোসেন পুকুর সংস্কারের আবেদন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে। সেখানেও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, জমিটি আবাদি শ্রেণীর। তবে নিচু জলাশয়ের মতো অবস্থানের কারণে এতে ঘাস জমে আছে এবং আবাদের অনুপোযোগী। বর্ষায় পানি জমে থাকার কারণে এখানে সময়মতো কোনো আবাদ করা সম্ভব হয় না।

দুই তদন্ত প্রতিবেদনেই জমি আবাদের অনুপোযোগী উল্লেখ করলেও, পুকুর হিসেবে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ইউএনও, এসি-ল্যান্ড এবং ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা ওই দুই জমি থেকে পুকুর হিসেবে খাজনা আদায় করছেন।
আর প্রশাসনকে খাজনা দিয়ে আবাদি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খননের সুযোগ পাচ্ছেন জমির মালিক।
দেশের শস্য ভাণ্ডারখ্যাত নাটোর জেলার প্রায় বেশির ভাগ জমিতে বছরে ৩ থেকে ৪টি করে ফসল হয়। নাটোরসহ দেশের ৩০টি জেলাকে কৃষি অর্থনৈতিক অঞ্চল (এইজেড) ঘোষণা করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কিন্তু কিছু অসাধু ইটভাটা মালিক অতি লাভের আশায় আবাদি জমিতে পুকুর খনন করছেন। ইটভাটা নিয়ন্ত্রন আইনে কোনো অবস্থাতেই আবাদি জমি, পাহাড়, টিলা কেটে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে মাটি ব্যবহার করার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, মানছেন না ভাটা মালিকরা।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার শেরকোল ইউনিয়নের নীলচরা এলাকায় প্রায় ৩০ বিঘা আবাদি জমিতে চলছে পুকুর খননের কাজ। এই মাটি যাচ্ছে সিংড়া উপজেলার ১৬টি ইটভাটায়।
ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এবং সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জান্নাতুল ফেরদৌস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইউএনও এবং জেলা প্রশাসনের মৌখিক অনুমতি নিয়েই নলিচরা এলাকার ৩০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছি।'
তবে সিংড়ার ইউএনও মো. সামিরুল ইসলাম অনুমতি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'আবাদি জমিতে পুকুর খননের খবর পেলেই বন্ধ করে দিচ্ছি।'
অথচ শুধু সিংড়া উপজেলার বড়গ্রাম, বিনগ্রাম, বনকুড়ি, কোমগ্রাম, বাঁশবাড়িয়া, দুর্গাপুরসহ প্রায় ১৫টি জায়গায় চলছে আবাদি জমি খনন। অন্যদিকে জেলার ৭টি উপজেলার প্রায় ১০টি জায়গায় চলছে পুকুর খননের কাজ।
তবে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন আশ্বাস দিলেও, এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমানের আবাদি জমিতে চলছে নতুন পুকুর খনন। সরকারি রেকর্ডে এটি আবাদি শ্রেণীর জমি। কিন্তু ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বাড়তি টাকা দিয়ে তিনি এই পুকুর খননের অনুমতি পেয়েছেন।
কৃষক মতিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আর আমার ভাই পুকুর খননের জন্য ভূমি অফিসে যোগাযোগ করি। ভূমি অফিসের কর্মকর্তা বলেছেন যে পুকুর হিসেবে খাজনা দিলে, পুকুর কাটতে দেওয়া হবে। আমরা পুকুরের খাজনা দিয়ে পুকুর কাটছি।'
ফসলি জমির খাজনা পুকুর হিসেবে আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বাগাতিপাড়ার ইউএনও প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, 'সরকারের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের জন্য আমরা পুকুরের খাজনা নিচ্ছি।'
জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত আনজুম অনন্যা বলেন, 'এটা ব্যবহারভিত্তিক খাজনা আদায়।'
তবে পুকুর হিসেবে ব্যবহার শুরুর আগেই কীভাবে পুকুরের খাজনা আদায় করলেন, জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার উপর চাপিয়ে দেন।

জামনগর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা বদরুজ্জামান অবশ্য নিজে দায় না নিয়ে বলেছেন, 'ইউএনও স্যারের নির্দেশে আমি এই কাজ করেছি।'
যোগাযোগ করা হলে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুকুর খননের সুযোগ করে দিতে আবাদি জমিকে পুকুর হিসেবে দেখিয়ে খাজনা আদায় করার কোনো সুযোগ নেই। এমন কাজ যদি কেউ করে থাকে, তদন্ত করে প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
জানা যায়, গত ১০ বছরে নাটোর জেলায় আবাদি জমি কমেছে ৮ হাজার ৬৮৫ হেক্টর। আর অপরিকল্পিত পুকুরের কারণে জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে আরও ৬০২ হেক্টর জমি। এখনই কঠোর আইন তৈরি না হলে আগামীতে আবাদযোগ্য জমি শূন্যের কোটায় যাওয়ার আশঙ্কা সচেতন মহলের।
নাটোরের সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রনেন্দ্রনাথ রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা জমির মালিকের অন্যায় কাজে সহযোগিতা করছেন। এমন কাজ তারা সরল বিশ্বাসে করছেন, এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা এসব কাজ করছে বলে মনে করি।'
আবাদি জমি এভাবে কমতে থাকলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ারও সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার নির্বাচনী এলাকায় এ ধরনের কাজ প্রশাসনের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা করছেন বলে শুনেছি। এটা খুবই অন্যায়। প্রশাসনের এসব আবাদি জমি রক্ষা করার কথা। তারা যদি তা না করে ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে আবাদি জমি খননের সুযোগ করে দেয়, তাহলে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।'
'এ ধরনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে,' বলেন তিনি।
Comments