যুদ্ধের ঈদ, ঈদের দিনের যুদ্ধ

রৌমারী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিনে এক মুক্তিযোদ্ধা। ছবিটি ব্যাটম্যান আর্কাইভ থেকে নেওয়া।

একাত্তরের ঈদ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ঈদ। আমাদের জাতীয় জীবনে যে ঈদটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। একাত্তরের ঈদের দিনটি এসেছিল ভীষণ অচেনা রূপে। চিরায়ত আনন্দ উচ্ছ্বাসের বদলে ঈদের দিনটি ছিল উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের। রণাঙ্গনে এই দিনটি ছিল লড়াইয়ের। মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আত্মদানের, আত্মত্যাগের। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে 'ঈদের দিন' বলতে আলাদা কোনো তাৎপর্য ছিলনা। ঈদের দিন কোনো কোনো রণাঙ্গনে প্রাণ হাতের মুঠোয় রেখে গোটা দিনই যুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। কোথাও বা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন স্বদেশের তরে। কেবল তাদের সামনে তখন একটিই গন্তব্য, 'দেশকে যে করেই হোক হানাদার মুক্ত করতে হবে।'

রণাঙ্গনের ঈদের দিনটি কেমন ছিল কেমন ছিল তা কিছুটা উঠে এসেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবে আলমের বর্ণনায়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তিনি নিজের তিনটি নোট বুকে প্রতিদিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছিলো 'গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে' নামক গ্রন্থে। 

মুক্তিযুদ্ধের ঈদ প্রসঙ্গে মাহবুব আলম লিখেছিলেন, 

'ঈদ এসে গেল। ছেলেরা ঈদ উৎসব পালনের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে এরকমের যে, ঈদের দিন পাক আর্মি ব্যাপকভাবে হামলা করবে সীমান্ত এলাকাগুলো জুড়ে। গুজবটা যেভাবেই ছড়াক, যথেষ্ট বিচলিত করে তোলে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঈদের নামাযের জন্য জামাতে দাঁড়াবে ঠিক সে সময়ই নাকি করা হবে এই হামলা! ….তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই পাকবাহিনীর তরফ থেকে এ ধরনের সম্ভাব্য হামলাকে সামনে রেখে আমরা ঈদুল ফিতর উৎসবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেই। ঈদের নামায পড়া হবে না, ঈদের উৎসবে হবে না, ভালো খাওয়া-দাওয়া হবে না, ঈদের দিন সবাই হাতিয়ার হাতে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে থাকবে, এরকম একটা কিছু কেউই যেন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। ..…ছুটি নেই, আরাম নেই, বিশ্রাম নেই। বড়ো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর জীবন সবার। এর মধ্যে ঈদের উৎসব একটা খুশির আবহ নিয়ে এসেছে। …..সিদ্ধান্ত হয় ঈদের আগের দিন সবগুলো দল দু'ভাগে ভাগ হবে এবং সমবেত হবে দু'জায়গায়। নালাগঞ্জ আর গুয়াবাড়িতে। ছেলেরা তাদের নিজেদের মতো করেই ঈদ উৎসব পালন করবে। তবে নামাজ পড়বে একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে। গুয়াবাড়িতে সমবেত ছেলেরা ভারতীয় সীমান্তে উঁচু গড়ের পাদদেশে গিয়ে জামাত পড়বে।' 

ঈদের নামাজের প্রসঙ্গে মাহবুব আলমের বর্ণনা পাওয়া যায় অপরূপ সম্প্রীতির চিত্রও। 

'নালাগঞ্জে জামাত হবে আমগাছ তলায় পুকুরের পাড়ে। মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামায পড়বে।…..হিন্দু ছেলেরা তাদের মুসলমান ভাইদের নামাযের সময় পাহারা দেবার দায়িত্ব পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এই যুদ্ধের মাঠে জীবন-মরনের মাঝখানেই সবার বসবাস। '

মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম। মুক্তিযুদ্ধের ঈদ নিয়ে তিনি তাঁর 'একাত্তরের ঈদের এই দিনে' প্রবন্ধ লিখেছিলেন, 

'২০ নভেম্বর পবিত্র ঈদের দিনে আমরা আশা করেছিলাম অন্তত এইদিন পাকিস্তানিরা আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ বা সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ছিল এর বিপরীত দৃশ্য। ঈদের দিন সকাল থেকেই পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিটি অবস্থানেই ব্যাপকভাবে আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। আমাদের কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতের সাহায্যে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি। তাছাড়া ঈদের দিনে গোসল করা, নতুন জামা-কাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।' 

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিনে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য বীরত্বের অবিশ্বাস্য কীর্তি স্থাপন করেছিলেন শহীদ লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ বীর উত্তম। 

৬ নং সেক্টরে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের পর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগ দিতে বদলির আদেশ এসেছিল আশফাকুস সামাদের। কিন্তু ইতোমধ্যে সহযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহর সঙ্গে রায়গঞ্জ আক্রমণের পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন তিনি। ইচ্ছে ছিল এই যুদ্ধের পরেই তিনি হেড কোয়ার্টারে যাবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হলোনা। রায়গঞ্জের যুদ্ধে ঈদের দিন তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা বীরত্বের যে ইতিহাস স্থাপন করেছিলেন তা ইতিহাসে বিরল। 

ঈদের আগের দিন চাঁদরাতে রাত ৯টার দিকে আশফাকুস সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ'র নেতৃত্বে দুই গ্রুপ কমান্ডো পাকিস্তানি হানাদারদের ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।

লেফটেন্যান্ট সামাদের দলে ছিলেন কমান্ডো মাহবুব সহ বেশ কয়েকজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে লেফটেন্যান্ট আব্দুল্লাহর সঙ্গে ১৫ জন শক্তিশালী কমান্ডো। পূর্বেই নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০০ গজের মধ্যে গিয়ে সামাদ এবং আবদুল্লাহ নিজেদের পজিশন জানান দেবেন। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পরে রাত সাড়ে ১১ টার দিকে এফইউপিতে পৌঁছালে মাত্রই তাদের বিন্দুমাত্র অসতর্কতার সুযোগে হানাদার বাহিনী তাঁদের অবস্থান টের পেয়ে যায়। রায়গঞ্জ ব্রিজটি পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করায় হানাদার বাহিনী নদীর উভয় পাশে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানরত এলাকা আর্টিলারি ও ছয়টি মেশিনগানের গুলিবর্ষণের আওতায় এনে মুক্তিবাহিনীকে একপ্রকার ঘেরাও করে ফেলে। 

রায়গঞ্জ ব্রিজের কাছাকাছি পোঁছাতেই আশফাকুস সামাদ দেখলেন ব্রিজের কাছেই ২৫ পাঞ্জাবের এলএমজি বাঙ্কার, তৎক্ষণাৎই তিনি বুঝে গেলেন রেকিতে ভুল হয়েছে এবং তারা হানাদারদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন। 

তখন লেফটেন্যান্ট সামাদ শিস দিয়ে সহযোদ্ধাদের শুয়ে পড়তে বললেন। এরপর ওয়্যারলেস সেট চালু করে লেফটেন্যান্ট আব্দুল্লাহর উদ্দেশ্যে 'হ্যালো আবদুল্লাহ?' বলতেই হানাদার বাহিনী একযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আর্টিলারি, মর্টার ফায়ার এবং মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। হানাদারদের ভয়াবহ গোলা ও গুলিবর্ষণে টার্গেট এলাকার মধ্যে থাকা আশফাকুস সামাদ সহ মুক্তিযোদ্ধারা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিযোদ্ধারা উদ্যম হারিয়ে ফেললে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঠিক তখনই সদর্পে লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ বললেন, 'কেউ এক ইঞ্চিও পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরবো। বাঁচলে সবাই বাঁচবো।' মুহূর্তের মধ্যে হারানো মনোবল ফিরে পেলেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হলো চরম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। তখন ঈদের দিনের ভোর ঘনিয়ে আসছে। হানাদারদের আক্রমণের তীব্রতা চতুর্গুণ বেড়ে গেলে আশফাকুস সামাদ এক ভিন্ন পরিকল্পনা আঁটেন। হানাদারদের বিভ্রান্ত করার জন্য দ্রুত তিনি নিজের পজিশন পাল্টে ২০০ গজ পিছনে সরে একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে মেশিনগান পোস্ট স্থাপন করেন। একই সঙ্গে সহযোদ্ধা সুবেদার আরব আলীকে তাঁর পিছনে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হানাদারদের আর্টিলারি ফায়ারের বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সুবেদার আরব আলী দলনেতাকে একা ফেলে যেতে রাজি নন। তাঁর তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও লেফটেন্যান্ট সামাদ অনড়। 

একপর্যায়ে নির্দেশ না শোনায় ক্ষেপে গিয়ে লেফটেন্যান্ট সামাদ বলেই ফেললেন 'আমার কথা না শুনলে আমরা সবাই মরবো। আপনারা আর্টিলারির বাইরে যান।' একপর্যায়ে সুবেদার আরব আলী সহ সহযোদ্ধারা পিছু হটলেন। ঠিক তখনই ওয়্যারলেসে ভারতীয় আর্টিলারির সাহায্য চান সামাদ। কিন্তু কোন প্রতিউত্তর এলোনা। তখন হানাদারদের তিনটি মেশিনগানের কভার একাই দিচ্ছিলেন সামাদ। হানাদারদের বিভ্রান্ত করতে অবস্থান বদলের বিকল্প ছিলোনা আশফাকুস সামাদের কাছে। তাই তিনি দ্রুত অবস্থান পাল্টে বাঁশঝাড় থেকে সামান্য সরে কাছেই থাকা একটি শিমুল গাছের নিচে অবস্থান নেন। কিন্তু তাঁর মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ থামেনি একটিবারের জন্য ও। 

হঠাৎ গোলার আলোতে আশফাকুস সামাদের অবস্থান নির্ণয় করেই হানাদার বাহিনীর তিনটি মেশিনগান পোস্ট একসঙ্গে গর্জে উঠে। একটু দূরে অবস্থান করা মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক স্বচক্ষে দেখলেন আশফাকুস সামাদের হেলমেট ফুটো করে কপাল ছিদ্র করে ঢুকে গেছে শত্রুর গুলি। হানাদারদের তীব্র আক্রমণে আশফাকুস সামাদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঈদের পরদিন ২১শে নভেম্বর তাঁর লাশ যখন উদ্ধার করা হয়েছিলো তখন তাঁর পকেটে পাওয়া গিয়েছিলো ঈদের দিনের সকালের নাস্তা হিসেবে রাখা দুটি রুটি আর কিছুটা হালুয়া। 

ঈদের দিনে লেফটেন্যান্ট আশকাফুস সামাদ সহ মাত্র কুড়িজন মুক্তিযোদ্ধা দুর্ধর্ষ ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক ব্যাটেলিয়ন সেনার মুখোমুখি হয়ে যে বীরত্ব আর দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তা মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। তাঁদের একটিই লক্ষ্য ছিল সেদিন, হয়তো তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীকে নিঃশেষ করে দিবেন নয়তো নিজেরা শহীদ হবেন। মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও শহীদ হওয়ার আগপর্যন্ত স্টেনগানকে চোখের পলকের জন্য নিজের হাত থেকে সরাননি। সাত আটটি বুলেট লেগেছিলো শরীরে এরপরেও স্টেনগান হাতে চালিয়ে গেছেন লড়াই। 

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিনেই ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কে ৩০ মাইলব্যাপী সড়কে ছোটবড় সর্বমোট ১৮টি সেতু উড়িয়ে দিয়েছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা। টাঙ্গাইলের মীর্জাপুর থানার ভাতকুঁড়া থেকে গাজীপুর মহকুমার কালিয়াকৈর থানার মহিষবাথান পর্যন্ত ছিল এই সেতুগুলোর অবস্থান। এর মধ্যে ভাতকুঁড়া সেতুর বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। 

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিনেই ফেনীর ছাগলনাইয়ার মোহাম্মদপুর প্রতিরক্ষাব্যূহ রক্ষা করতে গিয়ে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে শহীদ হয়েছিলেন সাত মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে ৩ নভেম্বর ভারতের উদয়পুরে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হওয়া কনফারেন্সে ক্যাপ্টেন মাহফুজকে মুহুরি নদীর পূর্বদিকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। ঈদের আগের দিন রাতে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় ৬ নং জাঠ রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ে চাঁদগাজী বাজারের কাছে মোহাম্মদপুরে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেন। ঈদের দিন ভোরের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্যাংক, ভারী অস্ত্র গোলাবারুদে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টা আক্রমণ গড়ে তুলেন। দুইপক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। হানাদারদের তীব্র আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এতে কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও ক্যাপ্টেন মাহফুজের অসীম অনুপ্রেরণায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধারা। একপর্যায়ে যৌথ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে হানাদার বাহিনী। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা আগেই চাঁদগাজী পর্যন্ত পুরো রাস্তায় মাইন পেতে রেখেছিলো। যুদ্ধ শেষে যখন ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর বাহিনী সহ চাঁদগাজীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তখন রাস্তায় হানাদারদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। 

৬ নম্বর সেক্টরের ভারত সীমান্তবর্তী লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থান। এই ঘাঁটি থেকে হানাদার বাহিনী পুরো হাতিবান্ধার বাসিন্দাদের উপর পৈশাচিকতা ও নির্মমতা চালিয়ে যাচ্ছিলো। তখন ঈদের আগের দিন চাঁদরাতেই মুক্তিবাহিনী পরিকল্পনা করে ঈদের দিনেই হাতিবান্ধার হানাদারদের শক্ত ঘাঁটিটি দখল করতে হবে। কারন এদিন হানাদার সেনারা বিশ্রামে থাকবে, নয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত থাকবে। আর এই সুযোগে সফল আক্রমণ করা যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর চারটি কোম্পানি ঈদের দিন সকাল ৮টার দিকে হানাদার বাহিনীর উপর যখন দ্বিমুখী আক্রমণ চালায় তখন হানাদার সেনাদের একটি কোম্পানি বদল হচ্ছিলো। কিছু সেনা হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছে, কিছু সেনা টহলে গিয়েছিলো এবং নতুন কোম্পানির কিছু সেনা মাত্র ঘাঁটিতে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ফায়ারেই পাকিস্তানি বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার নিহত হয়। কমান্ডার নিহত হওয়া মাত্রই মুক্তিবাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণে ঘাঁটি ছেড়ে পালাতে শুরু করে হানাদার সেনারা। এসময় পালাতে গিয়ে অর্ধশত সেনা নিহত হয়। প্রায় ১০০০ গজ দৌড়ে হানাদার সেনারা যখন গ্রামের মধ্যে থাকা নিজেদের আর্টিলারি পজিশনে গিয়ে হাজির হয় তখন তারা দ্রুত মুক্তিবাহিনীর উপর আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে মুক্তিবাহিনীর বার্তা পেয়ে ভারতীয় আর্টিলারি গান পাল্টা ফায়ার শুরু করলে পাকিস্তানি বাহিনীর পুরো ইউনিট ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। ঈদের দিনের এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন অন্যদিকে প্রায় দেড়শোর মতো হানাদার সেনা হতাহত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিন ভারতীয় সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। 

কুড়িগ্রাম- উলিপুর রেললাইন দিয়ে নিয়মিতই কুড়িগ্রাম থেকে পাকিস্তানি বাহিনী সেনা ও রসদ পরিবহণ করতো পাকিস্তানি বাহিনী। সামরিক দিক থেকে হানাদার বাহিনীর জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই রেললাইনে নিয়মিতই প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ট্রেন ধ্বংসের চেষ্টা চালাতেন মুক্তিবাহিনীর খায়রুল আলম কোম্পানি। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেনের ক্ষতি এড়াতে ট্রেনের সামনে মাটিবোঝাই ওয়াগন রাখতো। যেন মাটিবোঝাই ওয়াগন উড়ে গেলেও ট্রেন সুরক্ষিত থাকে। এসময় কারণে খায়রুল আলম কোম্পানি সফল হতে পারছিল না। 

এই রেললাইন ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিবাহিনীর খায়রুল আলম কোম্পানি নিয়মিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের ১৮ই নভেম্বর অর্থাৎ ২৮ রমজানের দিন চাঁদ প্লাটুনের কমান্ডার তাহমিদুর রহমান চাঁদ ও সেকশন কমান্ডার জসীম কোম্পানি কমান্ডার খায়রুল আলমের কাছে প্রস্তাব করেন তাঁরা হালাবটগাছতলার কাছে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে ও অ্যামবুশ করে হানাদার সৈন্যবাহী ট্রেন ধ্বংস করবেন। মূলত ২৩শে রমজান উলিপুরের হাতিয়ায় হানাদারেরা নিরীহ গ্রামবাসীর উপর চালানো পৈশাচিক গণহত্যার প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা চালানোর পরিকল্পনা হয়েছিলো। হালবটগাছ ছিল কুড়িগ্রাম- উলিপুরের রেললাইনের পার্শ্ববর্তী বেলগাছা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। 

পরিকল্পনা করা হয় ঈদের দিন ভোর পাঁচটার দিকে এই অপারেশন করা হবে। এই অপারেশনের জন্য কোম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে তিনটি অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন সরবরাহ করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা হালাবটগাছের কাছে রেললাইনের স্লিপারের নিচে একসঙ্গে তিনটি অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে রেখে ২০০-৩০০ গজ দূরে এসে ডেটোনেটরের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঈদের দিন সকাল ৯টার দিকে হানাদার সেনাবাহী একটি ট্রেন কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুরের দিকে যাচ্ছিল। ট্রেনের মাটিভর্তি প্রথম বগি ও ইঞ্জিন পার হলে হানাদার সেনাবাহী বগিটি অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইনের উপর উঠে এলো। তখনই মুক্তিযোদ্ধা জসীম ডেটোনেটরের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটান। সাথে সাথেই হানাদার সেনাবাহী বগিটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় দুমড়েমুচড়ে রেললাইনের পাশে পড়ে যায়। পিছনের বগিগুলোও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অপারেশনে সেনাবাহী বগিতেই হানাদার বাহিনীর ১৯ সেনা নিহত হয়। 

যেসব হানাদার সেনা জীবিত ছিল তারা ট্রেন থেকে নেমেই মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। সেকশন কমান্ডার জসীমের নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালেও তা যথেষ্ট ছিল না। কারন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ জন। প্রায় ১ ঘণ্টা গোলাগুলির পর পশ্চিম দিক থেকে জসীম সেকশনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে তার কোম্পানি। তখন হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। 

 

তথ্যসূত্র:

১/ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খন্ড

২/ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ১, ৬ এবং ১১

৩/ গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে/ মাহবুবে আলম

৪/ একাত্তরের ঈদের এই দিনে/ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম

 

 

Comments

The Daily Star  | English
Touhid Hossain Rohingya statement

Rohingya repatriation unlikely amid Myanmar’s civil war: foreign adviser

He highlights the 2017 mass exodus—prompted by brutal military crackdowns was the third major wave of Rohingyas fleeing Myanmar

34m ago