পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জবাবদিহিতা ও উৎকর্ষতায় প্রয়োজন অর্থায়ন পদ্ধতির সংস্কার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কার দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ।
ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের আলোচনা প্রায়শই শোনা গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ কথাবার্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বুঝতে অসুবিধা হয়নি কেন এসব আলোচনা ছিল অকার্যকর। সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রশাসনিক পদে আসীনদের গা ঢাকা দেওয়া শুধু সমস্যার গভীরতার নির্দেশকই না, বরং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকেও ইঙ্গিত করে।

ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পর নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন আশার সঞ্চার করছে। বাস্তবিক পরিবর্তনে তাই প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। এই বিপ্লবে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, আহত হয়েছেন এবং যারা দেশ পুনর্গঠনে অবিরাম কাজ করছেন, তাদের ত্যাগ এই সংস্কারের পথকে প্রশস্থ করেছে। এক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কার দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেবল জ্ঞান বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নয়, বরং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং যেকোনো সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধানকেন্দ্র হিসেবে গড়তে হবে। বর্তমান অর্থায়ন পদ্ধতি শিক্ষা কার্যক্রম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন কীভাবে শিক্ষার মান, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও দেশীয় সমস্যার সমাধানে উন্নতি আনতে পারে, সেদিকে মনোযোগ জরুরি। জ্ঞান বিতরণে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলো এমন স্নাতক তৈরি করবে, যারা পরিবর্তনশীল শ্রমবাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম। তাই দরকার বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার এবং বেসরকারি খাতের শক্তিশালী সহযোগিতা।

বর্তমান জ্ঞান বিতরণ পদ্ধতিতে শিক্ষায় অর্জিত সাফল্য প্রায়শই চাকরির বাজারে যথাযথ মূল্যায়ন পায় না। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষাদান পদ্ধতি, পরীক্ষা-নির্ভর নিরীক্ষণ বা মূল্যায়ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, জ্ঞানার্জনে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অভাব উল্লেখযোগ্য। প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উন্নতির কারণে কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজার সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের শেখার কৌশল শিখতে গুরুত্ব দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: একজন শিক্ষার্থী ইতিহাস পড়ছেন, কিন্তু কাজ করছেন ইউটিউবার বা ব্যাংকার হিসেবে। প্রথমে মনে হতে পারে ইতিহাস শেখার কোনো প্রায়োগিক দিক নেই। কিন্তু ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে তিনি শিখেছেন সমস্যা সমাধানের কৌশল। এই শেখার প্রক্রিয়া তাকে নতুন কোনো বিষয়ে দক্ষ হতে দ্রুত সাহায্য করবে। আবার তিনি যদি ব্যাংকিং সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে সেই শেখার প্রক্রিয়াটি নতুন দক্ষতার জন্যও কার্যকর। আর এই কৌশলই জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন দক্ষতা অর্জনের হাতিয়ার হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ফলাফল শিক্ষার্থীর দক্ষতার একটি সূচক। তাই এই ফলাফলগুলোকে যেকোনো চাকরি পাওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে শক্তভাবে বিবেচনা করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্স চলাকালীন বেশি মনোযোগী হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরেকটি চ্যালেঞ্জ গবেষণা তহবিলের অভাব। অন্যান্য দেশের তুলনায় যদিও অপ্রতুল, তারপরেও বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা গবেষণায় ব্যয় হয়। কিন্তু গবেষণা ব্যয়টি কার্যকরভাবে পরিচালনার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া নেই, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। সঠিক কাঠামো এবং গবেষণা প্রকল্পের পরিকল্পনা থাকলে এই ব্যয়টি আরও কার্যকর করা যেত এবং গবেষণা থেকে অর্জিত জ্ঞান দেশের উন্নয়নে অধিকতর ভূমিকা রাখত। সরকার এক্ষেত্রে ইউজিসির মতো গবেষণা তহবিল বিতরণ কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যেখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কৃষি, অর্থনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট দপ্তর থাকবে। এই তহবিলগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিক্ষক ও গবেষকদের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ করা উচিত, যা দেশব্যাপী সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্ভাবন ও জ্ঞান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করবে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বাজেট বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে বা ইউজিসিতে জমা দেয়, পরে সরকার তা অনুমোদন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক পরিচালনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো হওয়া উচিত নয়। কারণ উচ্চতর শিক্ষার জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা। এই স্বচ্ছতার অভাবে করদাতাদের অর্থ কীভাবে এবং কোথায় ব্যয় হচ্ছে, তা সাধারণ জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে অজানা থাকে। উদাহরণস্বরূপ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষার্থীপিছু আনুমানিক ব্যয় প্রায় দুই লাখ ২৮ হাজার টাকা। সরকার প্রদত্ত  ৯১৩ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মোট শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ করে।

কল্পনা করুন, যদি ইউজিসি শিক্ষার্থীদের সরাসরি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রতি বছর দুই লাখ টাকার একটি স্কলারশিপ দেয় এবং সেই অর্থ সরাসরি টিউশন ফিতে ব্যয় হয়, তাহলে কেমন হয়। এই স্কলারশিপ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের আরও ক্ষমতা দেবে এবং তাদের শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করতে সহায়ক হবে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাধ্য হবে শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং চাহিদা-মোতাবেক সেবা দিতে। বাড়বে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জবাবদিহিতা। এই প্রক্রিয়াটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের বাজেট ব্যবস্থাপনায় আরও সুশৃঙ্খল করবে, তারা প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা তহবিল এবং র‌্যাঙ্কিংভিত্তিক তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী হবে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমানে র‌্যাঙ্কিং বা মূল্যায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। যেই কারণে করদাতাদের অর্থের মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকারিতা নিরূপণ করা যাচ্ছে না। নিয়মিত গবেষণার উৎকর্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টি পরিমাপের ভিত্তিতে জাতীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান মূল্যায়ন করা দরকার, যা ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করবে। তদুপরি এই মূল্যায়নগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করতে এবং শিক্ষকদের সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে উৎসাহিত করবে। র‌্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত সরকারি তহবিলের সুযোগও রাখা যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, যা ইতোমধ্যে কিছু কিছু ক্যাম্পাসে হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক নির্বাচনের এবং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও অলিখিতভাবে রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব থেকে যাবে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত অর্থায়ন পদ্ধতি শিক্ষার মান উন্নত করতে বাধ্য করবে এবং লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি কমাতে সহায়ক হবে। কারণ শিক্ষার মান, গবেষণার পরিমাণ, শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টি ও বাজেট ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশি ব্যস্ত থাকবে।

অবশেষে, বাংলাদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বিদ্যমান পুরোনো ঔপনিবেশিক কাঠামোর, বিশেষ করে উপাচার্যদের বিলাসী জীবনযাত্রার সংস্কার দরকার। এই ঔপনিবেশিক অবশিষ্টাংশগুলো শিক্ষার অকার্যকারিতা ও বৈষম্যের কারণও বটে। যেমন ধরুন, উপাচার্যদের আলাদা সীমানাবেষ্টিত আলিশান বাড়িতে থাকতে হবে কেন? এটা অবশ্য সরকারি কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা তো ঔপনিবেশিক রাজাদের দ্বারা নিয়োজিত হয়নি, তাদের অন্যান্যদের সঙ্গে বসবাস করা উচিত। এই সামন্তবাদই বাংলাদেশ অনেক জায়গার সমস্যা। আর তার বিলুপ্তি শুরু হোক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষান্নোয়নের সমস্যা এতটাই গভীর যে, একটির সঙ্গে আরেকটি সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক সমস্যা অন্যটি থেকে আলাদা করাও কঠিন। তবে অর্থায়নের মতো বড় ধরনের সংস্কার শুরু করলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সূক্ষ্ম সংস্কারগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে পারি। প্রস্তাবিত স্কলারশিপ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিকভাবে কোনো প্রভাব ফেলবে না। মূলত এখন যেমন বিনাবেতনে পড়াশোনা হয়, তেমনই থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই পরিমাণ অর্থ পাবে। তবে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার কারণে শিক্ষা ও গবেষণার মান পর্যায়ক্রমে উন্নত হবে।

নিবন্ধটি লিখেছেন ড. মোহাম্মদ হক, ড. আশরাফ দেওয়ান, ড. সুফিয়া সুলতানা, ড. মো. আসাদুজ্জামান, ড. কাজী খালিদ হাসান, ড. মো. সরফরাজ গণী আদনান, ড. ফজলুল কবির রব্বানী ও ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তারা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত।

Comments

The Daily Star  | English

Journalists who legitimised fascism will not be spared: Nahid

Information Adviser Nahid Islam today said journalists and writers who tried to give legitimacy to fascism and instigated mass killing through their writings will be brought to book

1h ago