পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি বিতর্ক

নাগরিক তালিকায় নাম রয়েছে কি না দেখতে আসামে নগাও জেলায় সরকারি অফিসের বাইরে উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়। রয়টার্স ফাইল ছবি

আসামের পর কি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এনআরসি হতে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন এখন কলকাতায় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি পরিচয় দিলে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হচ্ছে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও।

আর ওদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি ইস্যু শুধু মুখের তর্কে থেমে নেই বরং ইতিমধ্যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি মাঠে-ময়দানে নেমে পড়েছে ‘এনআরসি বাস্তবায়ন’ করতে এবং ‘বাস্তবায়ন রুখতে’।

আসামের নাগরিকপঞ্জি সংশোধন ও সংযোজনের কাজ আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। এরপর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে রাজ্যের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু প্রতিবেশী আরেক বাংলা ভাষার রাজ্য, যেখানে প্রায় নয় কোটির বেশি মানুষের বাস এবং তাদের মধ্যে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে বহু বাংলাদেশি হিন্দু-মুসলিম গিয়েছেন; এই মুহূর্তে সেই পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটি ঠিক কেমন তা নিয়ে গত কিছুদিন ধরে খোঁজ-খবর করেছে দ্য ডেইলি স্টার।

নাগরিকপঞ্জির পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। আসাম রাজ্যেরও শাসক দল বিজেপি। সেই বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ গতকাল (১৯ সেপ্টেম্বর) জানিয়েছেন, নাগরিকপঞ্জির দাবিতে তারা ইতিমধ্যেই আন্দোলন শুরু করেছেন। তার দাবি, পশ্চিমবঙ্গে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। আর সেটা করতে হলে আসামের মতো এনআরসি প্রয়োজন এই রাজ্যেও।

দিলীপ ঘোষ আরও বলেছেন, শীর্ষ আদালতের নির্দেশেই আসামে এনআরসি হচ্ছে। তাই পশ্চিমবঙ্গেও সেটা হতে পারে। আর সেটার জন্য প্রয়োজনে আমরা রাজ্যবাসীর পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবো।

এই বিষয়ে পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থানের কথা জানিয়েছেন রাজ্যের পৌর ও নগর উন্নয়ন বিষয়মন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ফিরহাদ হাকিম। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, বিজেপির এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো দিনই এ রাজ্যে বাস্তবায়িত হবে না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলবে না পশ্চিমবঙ্গে।

বহু দিন ধরে এই রাজ্যের মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করছে বিজেপি। উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে, হুমকি-ধামকি দিয়ে, এমনকি অপপ্রচার করে মানুষের মন পেতে মরিয়া চেষ্টা করছে বিজেপি- যোগ করেন ওই মন্ত্রী।

ফিরহাদ হাকিমের ভাষায়, ‘২০১৯ সালে বিজেপি রাজ্য থেকে শূন্য হয়ে যাবে। তারপর ওরা এসব নিয়ে কথা বলুক দেখি।’

বামফ্রন্ট নেতা সুজন চক্রবর্তী মনে করেন, ‘কোনোভাবেই এই ধরণের ধর্মভিত্তিক বিভাজন বামফ্রন্ট সমর্থন করে না। আমরাও করি না। এনআরসি বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা। এসব জুজু দেখিয়ে লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সচেতন।’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী মনে করেন, ‘এনআরসি নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূল রাজনৈতিক তাস খেলেছে। একদল বাঙালি অন্য দল হিন্দু নামের তাস খেলছে।’

বিজেপি এই মুহূর্তে ভারতের ১৯টি রাজ্য শাসন করছে। যদি তাদের সত্যিই জনসমর্থনের ভিত্তি থাকে বলে তারা বিশ্বাস করে তবে সব রাজ্যেই এনআরসি করে দেখাক- এই প্রশ্নও তোলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি।

বিজেপি সূত্র বলছে, গত সপ্তাহ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজ্যে তারা এনআরসি নিয়ে একটা জরিপ শুরু করেছেন। সেখানে তারা মানুষের মন বোঝার চেষ্টার পাশাপাশি অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী, উদ্বাস্তু তিনটির সংজ্ঞা ও পার্থক্য বোঝানোর চেষ্টা চালাবেন।

তবে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দ্য ডেইলি স্টারকে বিজেপি মহিলা মোর্চার প্রধান লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, এই জরিপটা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই হচ্ছে না গোটা ভারত জুড়ে শুরু হচ্ছে। অবৈধ বাংলাদেশি সনাক্ত করতে বিজেপি রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সাংগঠনিক কাজও করে যাচ্ছে।

তিনি এটাও জানান, আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন দাবিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নেও তারা রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করবেন।

এনআরসি নিয়ে কলকাতার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজও কিন্তু বিজেপিকে কটাক্ষ করছেন।

রাজ্যের শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার মনে করেন, গোটা বিষয়টি একটা অবৈধ ব্যাপার। কোনও দেশে বিদেশিরা এসে যদি নিরাপত্তার বিঘ্ন না করে ভালো কাজে যুক্ত থাকেন, তবে তো দেশ গঠনের তারাও ভূমিকা নিচ্ছেন।

বিজেপির এটা উদ্যোগকে ‘পুরোপুরি রাজনৈতিক’ বলেও মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

বিশিষ্ট নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী ঠাট্টা করে বলেন, ‘এনআরসি হলে কী আর করব। ব্যাগ গুছিয়ে পৈত্রিক ভিটায় চলে যাব। ওপারের মানুষগুলো আমাকে তাড়াবে না।’

তিনি মনে করেন, ভীষণ একটা ফ্যাসিবাদী শক্তি কেন্দ্রীয় সরকারে জুড়ে বসেছে। এই শক্তিকে পরাভূত করতেই হবে। এনআরসি ওদের রাজনৈতিক ইস্যু। এতে ওদের লাভ হবে, দেশের কোনও লাভ নেই।

প্রায় তিন দশক ধরে কলকাতায় বসে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন পরিতোষ পাল। দ্য ডেইল স্টারকে তিনি বলেন, এই এতো বছরে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবানে বিদ্ধ হচ্ছি এনআরসি ইস্যু নিয়ে। অনেকে প্রশ্ন করছেন, আসামে যারা চূড়ান্তভাবে বাদ পড়বেন তারা তো রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বেন। তাদের কি বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারবে সরকার? আর বাংলাদেশ সরকারই বা কেন নেবে তাদের।

অনেকে প্রশ্ন করে বলছেন, আমরা তো ৭১ সালের পরে এসেছি পশ্চিমবঙ্গে। এনআরসি হলে তো আমাদেরও একই অবস্থা হবে- আমরা কোথায় যাবো। বাংলাদেশ সরকার কি আমাদের নিয়ে কিছু ভাবছে?- যোগ করেন পরিতোষ।

উত্তর-চব্বিশ পরগনার বারাসতের বাসিন্দা সুজন ভৌমিক বলেন, ‘দেখুন এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে আমরা পূর্ব বঙ্গের। নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাড়ি ছিল। এখন আমরা ভারতের নাগিরক। আমাদের ছেলে-মেয়েরা সবাই এই রাজ্যে জন্মেছে। এনআরসি হলে কী হবে সেই শঙ্কায় রয়েছি। যদি আমাদের তাড়িয়ে দেয় আমরা না হয় চলে যাবো, কিন্তু এই শিশুরা যারা ভারতে জন্মেছে তারা কি করবে?’

রাজারহাটের বাসিন্দা মহম্মদ দাইয়ান আলী শেখ বললেন, নোয়াখালি সোনাইমুড়িতে থাকতেন তার বাবা। তবে তার জন্ম কলকাতায়। বিধাননগর পৌর নিগমের চাকরি করেন তার বড়ভাই। আলী পেশায় একজন গাড়ি চালক।

দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদককে আলী শেখ বলেন, ‘দেখুন, আমরা তো সাধারণ মানুষ। খেটে জীবন নির্বাহ করছি। কারো কোনো ক্ষতি করি না। কোনও মামলা-মোকদ্দমা নেই আমাদের বিরুদ্ধে। এনআরসি হলে আমাদের তো আমার জন্মভূমি ভারত ছাড়তে হবে। তাই বিকল্প কিছু ভাবনা করে রাখছি আমরা…।’ তবে সেই ভাবনা নিয়ে আর মুখ খুলতে চাননি আলী।

Comments

The Daily Star  | English

UN says cross-border aid to Myanmar requires approval from both govts

The clarification followed Foreign Adviser Touhid Hossain's statement on Sunday that Bangladesh had agreed in principle to a UN proposal for a humanitarian corridor to Myanmar's Rakhine State

2h ago