তারেক রহমানের রাজনীতি

সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পারিবারিক গণ্ডির বাইরে তারেক রহমানের তেমন কোনো পরিচিত ছিল না। ১৯৮১ সালের মে মাসে আরেকটি পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার সময় নিহত হন জিয়াউর রহমান। এর মধ্যেই প্রথমবারের মতো তারেক রহমানের কথা জানতে পারে দেশবাসী।
tarique rahman
বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ফাইল ফটো

সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পারিবারিক গণ্ডির বাইরে তারেক রহমানের তেমন কোনো পরিচিত ছিল না। ১৯৮১ সালের মে মাসে আরেকটি পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার সময় নিহত হন জিয়াউর রহমান। এর মধ্যেই প্রথমবারের মতো তারেক রহমানের কথা জানতে পারে দেশবাসী।

জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট থাকার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠান প্রচার হতো। প্রয়াত ফজলে লোহানীর এই অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই জানা যায় রাষ্ট্রপতির দুই ছেলে রয়েছেন এবং বড় ছেলের নাম তারেক রহমান। কোনো কারণে জিয়াউর রহমান চাইতেন না তার পরিবারের সদস্যরা খুব বেশি জনসম্মুখে আসুক।

এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার আড়ালেই ছিলেন তিনি। সেসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে বিএনপির রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে প্রথমবারের মতো রাজনীতির ময়দানে তারেক রহমানের আবির্ভাব ঘটে। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে কর্মপন্থা সব কিছুই হতে থাকে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী। ওই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে নতুন ‘জিয়া’ হিসেবে সামনে আসেন তারেক। এরপরের কয়েক বছরের ইতিহাস বিএনপি ও সরকারের ওপর তারেক ও তার সঙ্গী-সাথীদের আধিপত্য, ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগের ইতিহাস।

বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে প্রধানমন্ত্রী-পুত্রের উত্থান চলতে থাকে তাতে তখন মানুষের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে অচিরেই তারেক ক্ষমতার রাজনীতিতে সওয়ার হয়ে দেশের শীর্ষ পদে উঠে যাবেন। কিন্তু, সেসময় তিনি এমন সব কাজে জড়িয়ে যান যাতে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচ্চাভিলাষ অপূর্ণ রয়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের আগে যেভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ গরম হতে দেখা যায় ২০০১ এর নির্বাচনের আগে আন্দোলন করার জন্য বিএনপির সামনে তেমন কোনো বড় রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না। ঠিক তখনই তরুণ নেতৃত্ব ও দলের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনার নামে ৩৪ বছর বয়সী তারেক রাজনীতির ময়দানে ঢোকেন। গুলশানে হাওয়া ভবন নামে একটি দোতলা বাড়িতে নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি তার কার্যালয় খোলেন। কিন্তু খুব শিগগিরই হাওয়া ভবন নামটি দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সন্ত্রাসের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

হাওয়া ভবনের দোতলায় একটি কক্ষে বসতেন তারেক। এই কার্যালয় খোলার পর থেকেই রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপির রাজনীতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝানো শুরু করেন। বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত, আওয়ামী লীগকে মোকাবিলায় কী কী করণীয় বা ভোটারদের মন জয় করতে কেমন কর্মসূচি দেওয়া উচিত এসব ব্যাপারে তাদের মতামতও নিতেন তারেক।

সেসময় নির্বাচনী কৌশল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে বিএনপির জোট গড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল পর্যায়ে ঝটিকা সফর শুরু করেন তারেক। জোট গঠনের কাজটিও হয় তার তত্ত্বাবধানেই। প্রায় সব জেলায় গিয়েই তিনি দলের তরুণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে শুরু করেন। মৌমাছি যেমন মধুর দিকে আকৃষ্ট হয় ঠিক সেরকমই একদল ‘উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ’ তার দিকে আকৃষ্ট হন তখন। তারেক নিজেই তার গাড়ি চালাচ্ছেন আর তার চারপাশে সমর্থকদের ঘিরে থাকার দৃশ্য খুবই সাধারণ হয়ে ওঠে। বাবার মতই গাড়ি থেকে বাইরের লোকজনের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা যেত তাকে। তার সমর্থকরা তাকে ঘিরে স্লোগান দিতেন— তারেক তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে, মোদের নেতা তারেক জিয়া। এই স্লোগানের মাধ্যমেই তারেক রহমানের নামের শেষে ‘রহমান’ বদলে দিয়ে ‘জিয়া’ ব্যবহার করতে শুরু করেন মানুষ।

বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের বাইরে এক জায়গায় লিখে দেওয়া হয়, জিয়া আমাদের নেতা ছিলেন, খালেদা জিয়া আমাদের নেতা ও তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে তারেকই যে দলের ভবিষ্যৎ নেতা হবেন এটা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। খালেদা জিয়ার ছেলে হিসেবে দলের মধ্যেও হঠাৎ করেই জ্যেষ্ঠদের টপকে গিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হয় তাকে। জ্যেষ্ঠ নেতারাও বুঝতে পারেন অভিজ্ঞতার ঝুলি তাদের যতই বড় হোক না কেন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তারেকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তারাও নির্বিবাদে তারেকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে থাকেন।

একদিন হঠাৎ করেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন তারেক। একে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে সেসময় ভূয়সী প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন তিনি।

নির্বাচন এগিয়ে আসতেই বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে নিজের প্রায় একক প্রচেষ্টায় বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করেন তারেক। সেই নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পেয়ে দলটি একাই ১৯৩ টি আসন জিতে নেয়। জোটের শরীকদের মিলিয়ে সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গঠিত হয় সরকার। সাফল্যের কৃতিত্ব তারেক পেলেও ক্ষমতার ঘরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা মিলিয়ে যেতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে একের পর এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের জন্ম দিতে শুরু করেন তিনি।

খালেদা জিয়া সরকারের প্রধান হলেও বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায় তারেকের হাওয়া ভবন। সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত আসতে থাকে তার কাছ থেকে।

এসময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করে তারেকের, যিনি একসময় ঘড়ি চোরাচালানের জন্য ‘ক্যাসিও বাবর’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। এসময় তারেকের অনুগত প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে হাওয়া ভবনে। তারাও বুঝে গিয়েছিলেন ক্ষমতার উৎস কোথায়।

এসময় আরও বেশ কিছু মানুষকে কাছে টানেন তারেক। এদের মধ্যে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুন, রুহুল কুদ্দুস দুলু, নাদিম মোস্তফা, আমিনুল হক ও আলমগীর কবিরসহ বেশ কয়েকজন। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর এই নেতাদের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের গভীর যোগাযোগ ছিল। সঙ্গে ছিল তারেকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ডের মিল। ‘উদার দৃষ্টিভঙ্গি’ ধারণকারী দল হিসেবে পরিচিতি থাকা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এদেরকে অস্ত্র হিসেবে পেয়ে যান তারেক।

আরেকটি পরিকল্পনা ছিল গিয়াসউদ্দিন মামুনের কাছে। তারেকের সম্পদ লিপ্সার সঙ্গে মিলে যায় তার চাওয়া পাওয়া। আর সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই কাজটি কিভাবে হাসিল করে নিতে হয় সেটিও খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি। দেশের ব্যবসায়ী সমাজের কাছে একটি বার্তা চলে যায় যে, যে কোনো ব্যবসা করতে চাইলে হাওয়া ভবন থেকে আশীর্বাদ লাগবে।

তারেক ও তার সহযোগীদের দুর্নীতি সেসময় এমনই মাত্রা ছাড়ায় যে উইকিলিকসেও তার কিছু নমুনা দেখা যায়। সেসময় খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের সঙ্গে ২০০৫ সালের ১৩ মার্চ আলাপে বলেছিলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত তারেক রহমানকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে চলেছেন। ২০১১ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন গোপন নথিপত্রে এই বিষয়টি উঠে এসেছিল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের আরেক রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ারটি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় উল্লেখ করেন যে, দুর্নীতিগ্রস্ত ও উগ্র এমন এক সরকার যে তার নিজের দেশের জনগণ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে- তার প্রতিনিধিত্ব করেন তারেক। ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট উইকিলিকস রাষ্ট্রদূতের পাঠানো এই বার্তাটি ফাঁস করে দেয়।

ওই বার্তায় আরও বলা হয়, ‘তারেক রহমান সরকারি তহবিল থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যমপন্থী (মডারেট) এই দেশটিতে স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টা নষ্ট করে দিচ্ছে।’

সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কাজ ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তারেক ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেও ফাঁস হওয়া ওই নথিতে উল্লেখ করা হয়।

মরিয়ারটি বলেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। এর ছয় মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসির পাঠানো বার্তায় বলা হয়, তারেক রহমানের ভিসা বাতিলের কথা চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।

এরপরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন ও ঘুষের অভিযোগ বাড়তেই থাকে ও শেষ পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর একে একে তারেকের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলার বিচার চলছে এখন।

এর মধ্যে ২০১৬ সালে একটি মামলায় তারেকের সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করার রায় দেন আদালত। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুনকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করতে সহায়তা করেছেন।

একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ হিসেবে এই টাকা নিয়েছিলেন মামুন। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই অর্থপাচারের এই ঘটনাটি তদন্ত করেছিল।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তারেককে।

এছাড়াও, বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তোলাবাজির একাধিক অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় একটি বিখ্যাত জার্মান কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তির মোট অর্থের ২ শতাংশ তিনি ঘুষ হিসেবে নিয়েছিলেন। একটি চীনা কোম্পানি কাজ পাওয়ার বিনিময়ে সিঙ্গাপুরে সিটি ব্যাংকের একাউন্টের মাধ্যমে তারেককে সাড়ে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ ধরনের অপকর্মের অভিযোগের অভিযোগও দীর্ঘ হতে থাকে তার বিরুদ্ধে। এখন পলাতক জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago