বাংলাদেশ, খোলা কবরের গল্পজমিন

আজকের বাংলাদেশ দিন বদলের গ্রাফিতি! এই গ্রাফিতি কল্পনার বাইরে দাঁড়ানো ঘটনা আর অঘটনার আঁচড়ে আঁকা অসমাপ্ত এক ক্যানভাস। এই ক্যানভাস মরতে মরতে বাঁচতে চাওয়া মানুষের জিতে যাওয়ার কেচ্ছার। কিন্তু এই কেচ্ছা নিদারুণ করুণ, খোলা কবরের গল্পনামা।

আয়েশি সোফায় গা ডুবিয়ে দূর আমেরিকার এক সুখী অ্যাপার্টমেন্টে বসে আমি মৃত্যুর গল্প পড়ি, জীবনের মৃত্যু দেখি। টিয়ারশেলের যেই ধোঁয়া আমার দেশে ফেলে আসা বারান্দাটার গ্রিল আঁকড়ে থাকে, তা আমার চোখ ছুঁতে পারে না। তবুও আমি ঝাপসা দেখি। কোনো স্নাইপার আমার বুক তাক করে বুলেট ছুড়ে না, তবুও আমার বুক টন টন করে। প্রিয় মানুষের রক্ত আমায় কাকভেজা করে না, তবুও আমার চারপাশ শুধু লাল-ই লাগে। সময়-স্থানের এই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েই, আমি তড়পাতে তড়পাতে দেখি প্রাণে প্রাণে কত তফাৎ, জীবন কতটা মৃত্যুর কাছাকাছি।

আব্দুর রহমান জিসান (১৮) রায়েরবাগ এলাকার দোকানে পানি সরবরাহ করতেন। ২০ জুলাই দুপুরে একটা বুলেট তার ডান চোখে চিড়ে বের হয়ে যায়। তার চেনা গলিতেই সে পড়ে রয় লম্বা সময়। নয়দিন পর জিসানের স্ত্রী মিষ্টি নিজ জীবনের অবসান ঘটায়। সমাজে এই মৃত্যু আত্মহত্যা বলে স্বীকৃত হলেও মিষ্টি জানতেন যে তিনি খুনের শিকার!

২১ জুলাই ৭/৮ বছরের এক ছেলে বাঁচার তাগিদে টাউন হল বাজারের এক গাছের আড়ালে লুকায়। হয়তো 'বাড়ি যাব' ভেবে তার উঁকি দেওয়ার মুহূর্তটাতেই বুলেট তাকে দেখে ফেলে। সেই ভোরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নাম না জানা সেই শিশু কিংবা তার মা কেউ-ই জানতেন না যে সেদিন-ই ছিল তার শেষ লুকোচুরি খেলা। রক্তে ভেজা সেই গাছটা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে এই খুনের সাক্ষী হয়ে।

সাংবাদিক এটিএম তুরাব ফুসফুস ও যকৃতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৯ জুলাই আইসিইউতে মারা যান। লন্ডন থেকে তার স্ত্রী তানিয়া আকুতি জানান তুরাবকে এক মুহূর্তের জন্যে হলেও দেখার। দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তানিয়া শেষ বিদায় জানাতে পারেননি তার জীবনের তুরাব নামের অংশটাকে। কিন্তু তুরাবের মা তার প্রিয় সন্তানকে বিদায় জানান ৯৮টি গুলিতে (প্যালেট) ঝাঁঝরা হওয়া দেহে শেষ আদরের হাত বুলিয়ে। শুনেছি এখনো মা বিলাপ করেন—'পুলিশ ক্যান আমার ছেলেরে মারল?'

তুরাবের মা একলা নন। তার বিলাপ কোটি মানুষের প্রতিবাদে মেশে—'হামার বেটাক মারলু ক্যানে?' স্বৈরাচার মারে। কারণ তার অস্তিত্বই টিকে থাকে খুনের রাজনীতির (নেক্রোপলিটিক্স) ওপর, যে রাজনীতি রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে জনগণের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে।

রাষ্ট্রের দলিল-দস্তাবেজের সুশীল আলাপে এই খুনি রাজনীতির হদিস নেই। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর প্রতিটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জনগণ দেখে এর বিস্তীর্ণ মানচিত্র। মানুষ জানে কীভাবে এই রাজনীতিকে পুঁজি করেই আওয়ামী লীগ সরকার খুনের নকশা তৈরি করে এবং নিজ জনগণকে সেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ক্যাম্পাসে ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের সহজ শিকারে পরিণত করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে খুন-জখমের মসৃণ জমি তৈরি করে।

নির্বিচার গুলির বৃষ্টি সাধারণ মানুষের প্রাণ নেওয়া নিশ্চিত করে। হাসপাতালে বাধ্যতামূলক আঙ্গুল ছাপ দেওয়ার চাপ আহত মানুষকে চিকিৎসা না নিয়েই মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে বাধ্য করে। আচমকা হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি নিজ চেনা ঘরে খেলতে থাকা শিশুর জীবন কেড়ে নেয়। প্যারামিলিটারি ইউনিটের যথেচ্ছ প্রয়োগ—যার শীর্ষদের নামে অত্যাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগ রয়েছে—নৃশংসতাকে নিদারুণ করে। এবং 'দেখামাত্র গুলি' করার কারফিউ মৃত্যুর সংখ্যা রাজপথ থেকে পাড়া-মহল্লায় ছড়ায়।

এই প্রতিটি হিসাবি সিদ্ধান্ত দেখায় যে রাষ্ট্র কীভাবে জনগণের ধ্বংস নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে একটা 'মৃত্যুপুরী' (ডেথ ওয়ার্ল্ড) তৈরি করে। এই প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে যে স্বৈরাচার সরকার তার সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এই রাষ্ট্রে কে বাঁচবে আর কে মরবে তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা আর শক্তি প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে। খুন করার এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জানান দেয় যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র লাশে লাশে দেশ খুন করে নিজ জনগণের বিরুদ্ধে এক নোংরা যুদ্ধ নাজেল করার মাধ্যমে।

আওয়ামী লীগ সরকার পুরো দেশকে এক 'বিচ্যুত ভূখণ্ড' হিসেবে পরিণত করে, যেখানে নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রের আগ্রাসন, ক্ষমতা, সহিংসতা জনগণের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হয় সাংবিধানিক ও মানবাধিকার আইনকে লোপাট করে। শেখ হাসিনা সরকার এমন এক সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করে যেখানে রাজনৈতিক, বাক-স্বাধীনতা এবং খোদ বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে জনগণ বেঁচে রয় স্রেফ 'জিন্দা-লাশ' হয়ে। জীবন, ক্ষমতা, ও অধিকারের দাবি ঠোঁটে নিয়ে মরতে থাকা এই মানুষ তবুও প্রতিবাদের শব্দ ছোড়ে। কিন্তু সবটা অধিকার হারানো এই জনগণ যখন শাসকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, তখন রাষ্ট্রের চোখে তারা কেবলই হত্যাযোগ্য জানোয়ারে পরিণত হয়। মৃত্যুর এই রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই সরকার একের পর এক খুন করে আর জিন্দা-লাশেরা লাশ হয়ে জানান দেয় যারা বেঁচে আছে, তাঁরাও পুরোটা বেঁচে নেই আসলে।

এই জুলুম, এই মৃত্যু-শাসন মৃত্যুর পরেও জারি থাকে। মৃতের প্রতি নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও সহিংসতা চলমান রেখে স্বৈরাচার তার দাপটের সীমানা আঁকে খুনের সীমানা পার হয়ে। সরকার শুধু খুনই করে না, বরং খুনের আলামত, গল্পছবি লোপাট ও বিকৃত করে। সে কারণেই এফআইআরে (পুলিশের প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) আবু সাঈদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পুলিশের ছোড়া গুলিকে আড়াল করা হয়। এই আড়ালের রাজনীতিকে শুধু 'বিস্মৃতির' রাজনীতি হিসেবে দেখলে বহু কিছু কম দেখা হয়। বরং একে বোঝা জরুরি যে গুলি খেয়েও শাল বৃক্ষের মতো বুক টান করে দাঁড়ানো এক তরুণের সাহসকে অগ্রাহ্য করার রাজনৈতিক ফন্দি হিসেবে। এই উপেক্ষাকে জানা প্রয়োজন জনপ্রতিরোধকে নিছক এক গল্পহীন লাশে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা হিসেবে।

শুধু সাঈদের নয়, প্রতিটি খুনের গল্পই রাষ্ট্রের বয়ানে বিকৃত, নির্মিত এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয় ('যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়, তাহলে তারা গুলি ছুড়বেন। মানুষ মরবে। সেটাই স্বাভাবিক'—এক মন্ত্রীর উদ্ধৃতি)। প্রতিটি জীবনই রাষ্ট্রের কাছে নিছকই খরচ-যোগ্য, তৃতীয় শক্তি, রাজাকার, বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের 'অপ্রয়োজনীয় জীবন' হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিটি লাশই এখানে রাষ্ট্রের জনশত্রু তকমা নিয়ে প্রিয় জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়।

বেঁচে যাওয়া বুকে ভয় জমাতে সেই পড়ে থাকা নিথর দেহেও রাষ্ট্রের বাহিনী ক্ষমতার উলঙ্গ প্রদর্শনী চালায়। ১৯ জুলাই মহাখালীতে ১৪ বছরের এক ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। মৃত সেই দেহে পুলিশ বারবার লাথি মারে মৃত্যুতেই যে সব শেষ নয় তা প্রমাণ করার জন্য। শিশুটির যেই দেহ তার প্রিয় মানুষের আদরে উষ্ণ ছিল, সেই দেহে সহিংসতা চলতে থাকে তার শেষ নি:শ্বাস পড়ারও বহু মুহূর্ত পর পর্যন্ত। রাষ্ট্র মৃতের বুকে দাঁড়িয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে।

এখানেই ইতি নয়। রাষ্ট্র মৃতের প্রতি এই সহিংসতার চূড়ান্ত রূপ দেয় লাশ গুম করার মধ্যে দিয়ে। গুমের এই রাজনীতি খুনি সরকারকে খুনের দায় অস্বীকার করার জমিন তৈরি করে দেয়। আর মৃতব্যক্তি হারান তার শেষবেলার শেষ আশ্রয়—নিজ কবরের এক টুকরা মাটি। প্রিয় হাত এক মুঠো মাটি হাতেই হাতড়ে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ। মৃত্যুর গায়ত্রী মন্ত্র ঠোঁটে নিয়েই পিতা তার সন্তানের নাম ধরে ডাকে—'সুবোধ তুই কই বাবা?' আর আমাদের অজানা রয়ে যায় কীভাবে কতশত পরিবার প্রিয়জনের অন্তহীন খোঁজে আটকা পড়ে জীবিত আর মৃত জগতের মাঝখানে। এই অস্পষ্ট বিচ্ছেদ স্বজনের যন্ত্রণাকে অনন্তকালের জন্য স্থির করে দেয়। এই ব্যথা, এই কান্না টিকে থাকে সময় গোনা শেষ হওয়ার পরেও; কোনোদিন এর ক্ষয় হয় না।

কিন্তু সরকার ভুলে যায় যে কোনো কিছুই হাওয়ায় মেশে না শেষ চিহ্ন রেখে না যেয়ে। প্রতিটি লাশ তার দেহে বয়ে বেড়ায় নিজ মৃত্যুগল্প। ভাঙা খুলি, ফুটো পাঁজর, চুরমার মেরুদণ্ড বলে যায় খুনি রাজনীতির কেচ্ছা। জনগণ জানে রাষ্ট্রের 'স্মৃতি-খুনের' এই জমানায় সবকিছু মনে রাখার দায় শুধু তাদের। বেঁচে যাওয়া মানুষ তাই মৃতের গল্প জমায়। যোগাযোগের বাধা ও মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করেই তারা ভাঙা হাড়, ভাঙা মন, ভাঙা জীবনের গল্প কুড়ায়, গল্প ছড়ায়। মৃতদের এই গল্প তাদের এক নতুন জীবনের গল্প গড়ার সাহস যোগায়, যেই জীবন 'জিন্দা-লাশের' না, যেই জীবনটা তাদের এখনো বাঁচা বাকি। মানুষ তাই লড়াই করে, কঠিন লড়াই, যতক্ষণ না বাংলাদেশে এক নতুন সূর্য ওঠে। শেষমেশ ভোর হয়!

কিন্তু এই নতুন ভোর একটা পূর্ণ দিন হয়ে ওঠার আগেই এক অনিশ্চিত আগামীকাল তাকে গ্রাস করতে থাকে। প্রতিশোধ ও সুবিচারের নামে নির্বিচার লুটতরাজ ও ভাঙচুর, অমুসলিম ও আদিবাসী জনগণের ওপর নির্লজ্জ হামলা এবং পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্মম খুন খুনিক্ষমতারই (নেক্রোপাওয়ার) পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এই আপাত উত্তর-স্বৈরাচারকালেও আমরা দেখি মানবতার অসম বণ্টন, যেখানে কিছু মানুষ (মুসলিম ও বাঙালি যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত নন) বেঁচে থাকার স্বীকৃতি পায়, আর বাকিরা (অমুসলিম, আদিবাসী, পুলিশ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী) নতুন 'জিন্দা-লাশ' হয়ে বাঁচে জীবনের উল্টো পিঠে।

যে জানে সে মানে কীভাবে অমুসলিম ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী সহিংসতার ত্রাস আর আতঙ্কে ধুকে ধুকে মরে। স্বজন হারানো মানুষ শোনে সেই ছয় শিশুর বাঁচার তীব্র চিৎকার, যাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর শাহ আলমের বাড়িতে। এই শিশুদের মাও হয়তো তুরাবের মায়ের মতো বিলাপ করেন—'আমার সন্তানকে মারল কেন?' প্রশ্ন হলো—এই দিন বদলের দিনে আমরা কি প্রস্তুত তার কান্না শুনতে?

খুনের রাজনীতির অবসান হওয়া হয়তো এখনো অনেক দূরের গল্প। এখনো এখানে প্রতিটি খুন খুনিক্ষমতারই (নেক্রোপাওয়ার) পুনরাবৃত্তি। যদিও প্রতিটি পুনরাবৃত্তিই নতুন; অতীত ও ভবিষ্যৎ থেকে ভিন্ন। মৃতের গল্প তাই চলমান। মৃতের গল্প অদ্বিতীয়। বাংলাদেশ তাই এখনো এক অন্তহীন খোলা কবরের গল্পজমিন।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: লেখক এবং টেক্সাসের সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Banks income from investment in bonds

Bond boom contributes half of bank income

The 50 banks collectively earned Tk 39,958 crore from treasury bonds in 2024, up from Tk 27,626 crore in the previous year, according to an analysis of their audited financial statements.

14h ago