খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতায় বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি ৫০০ কোটির বেশি

জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রামের সবচেয়ে পুরনো বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ২০২০ সালে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবের মধ্যে রয়েছে আছাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ ও চাক্তাই।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজার। স্টার ফাইল ছবি

জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রামের সবচেয়ে পুরনো বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ২০২০ সালে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবের মধ্যে রয়েছে আছাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ ও চাক্তাই।

পরিকল্পনা কমিশনের 'স্থানীয় বাণিজ্যে জলাবদ্ধতার অর্থনৈতিক প্রভাব: খাতুনগঞ্জ' শীর্ষক একটি সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অনুরোধে ন্যাশনাল রিসাইলেন্স প্রোগ্রামের আওতায় পরিকল্পনা কমিশন এই সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। এতে সহযোগিতা করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।

জলাবদ্ধতার কারণে খাতুনগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় অর্থনৈতিক ক্ষতি নির্ধারণে কোনো বাস্তবভিত্তিক সমীক্ষা আগে করা হয়নি। এ প্রেক্ষিতে জলাবদ্ধতার কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, ট্রেড বডি ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ সমীক্ষা করা হয়েছে। যা ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে সহযোগিতা করবে।

খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার গুদাম ও ২৫০টির অধিক পাইকারি দোকান রয়েছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ দেশের নিত্যপণ্যের বাজারের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে এই নিয়ন্ত্রণের বেশিরভাগ ঢাকা কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। জলাবদ্ধতাকে এর মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, যেখানে অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়িক জৌলুস হারানোর পেছনে দায়ী।

৫ হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জলাবদ্ধতার কারণে খাতুনগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ৫১৪ কোটি টাকা, যা ২০১১ সালে ছিল ১৭৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১০ বছরের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের আরেক অংশে শুধুমাত্র খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১ হাজার ২০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী গত বছর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১২৩ কোটি টাকা, যা ২০১১ সালে ছিল ৪১ কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক ক্ষতি নির্ধারণে পানিতে ভিজে পণ্য নষ্ট হওয়া, আংশিক নষ্ট পণ্যকে পুনরায় ভোগ উপযোগী করে তোলা, অতিরিক্ত শ্রমিক ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, মূলধনী সম্পত্তির ক্ষতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে বিক্রি কমে যাওয়াও অর্থনৈতিক ক্ষতি নির্ধারণে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সমীক্ষায় ব্যবসায়ীদের মানসিক ক্ষতির বিষয়টিও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ৯১ দশমিক ৫৩ শতাংশ ব্যবসায়ী হতাশায় ভুগছেন, ব্যবসায়ে অনীহা তৈরি হয়েছে ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ ব্যবসায়ীর এবং ক্রেতাদের কাছে সুনাম নষ্ট হয়েছে ৭১ দশমিক ১৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর।

সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৬৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং অবশিষ্ট ব্যবসায়ীরা সহনীয় পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

জলাবদ্ধতার কারণে শুধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়। পণ্য বাণিজ্য কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্য পরিবহন ও লোডিং-আনলোডিং, সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের মতে, ৩টি কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো হলো—জোয়ারের পানি, বৃষ্টির ধরণ পরিবর্তন এবং পলি জমা ও চাক্তাইসহ আশেপাশের খালগুলোর অবাধ পানি প্রবাহে বাঁধা।

ব্যবসায়ীরা এসবের সমাধানে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এতে ৩টি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তারা নিয়মিত চাক্তাই ও কর্ণফুলী খাল খনন, খালে স্লুইস গেট নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নকে সমাধান হিসেবে দেখছেন।

তবে সমীক্ষা প্রতিবেদনে চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদীর ঐতিহাসিক তথ্য, গতিপথ, দখল-দূষণ ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে জলাবদ্ধতার ৩টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো—প্রাকৃতিক, মানব সৃষ্ট ও গ্রহের প্রভাব (অমাবস্যা ও পূর্ণিমা)।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাস্টার প্ল্যান করা হয়। এতে চট্টগ্রাম শহরকে ১২টি ভাগে ভাগ করা হয়। যার ৫/এ এবং ৫/বি ভাগে রয়েছে চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ। মাস্টার প্ল্যানের সুপারিশ অনুযায়ী চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জের ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়নি, উপরন্তু চাক্তাই খালে মানুষ চলাচলের জন্য তৈরি করা ফুটওভার ব্রিজ নৌকা চলাচলকে বিঘ্নিত করেছে।

প্রতিবেদনে সমীক্ষার কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও বলা হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে শুধুমাত্র খাতুনগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নির্দেশ করে এই সমীক্ষা। পুরো শহরের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে আরও বড় আকারে সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। খাতুনগঞ্জের অর্থনৈতিক ক্ষতি এতে বিবেচনায় নেওয়া হলেও এর প্রভাব রয়েছে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতেও। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক ক্ষতির কারণও জলাবদ্ধতা। ব্যবসায়ীরা জলাবদ্ধতার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়। সময়ের স্বল্পতার কারণে পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
national election

US sanctions against Rab to stay: US State Department

The United States has said the sanctions imposed against Bangladesh's elite force Rab are not being withdrawn

38m ago