রক্তরোগ ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা আইটিপি নিয়ে যা জানা প্রয়োজন

ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা আইটিপি কোনো মারাত্মক রোগ বা ক্যানসার জাতীয় সমস্যা না। তবে এ রোগটি সম্পর্কে তেমন একটা শোনা যায় না বলে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
রোগটি বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের হেমাটোলজিস্ট ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিজিশিয়ান অধ্যাপক ডা. এম এ খান।
ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া কী ও ধরন
অধ্যাপক এম এ খান বলেন, রক্তে তিন ধরনের রক্তকণিকা থাকে। যেমন- রেড ব্লাড সেল, হোয়াইট ব্লাড সেল এবং প্লাটিলেট। রক্তে স্বাভাবিক প্লাটিলেটের সংখ্যা হচ্ছে ১৫০ হাজার থেকে ৪৫০ হাজার। যদি কোনো কারণে বা অকারণে প্লাটিলেটের সংখ্যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে (১৫০ হাজারের কম) কমে যায়, তখন এ অবস্থাকে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বলে।
ইমিউনোলজিক্যাল পদ্ধতিতে যদি রক্তের প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যায় তাকে ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বলে, তবে এক্ষেত্রে স্বীকৃত প্লাটিলেট কমের মাত্রা (কাট-অফ ভ্যালু) হচ্ছে এক লাখ বা তার কম।
ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া দুই ধরনের।
১. প্রাইমারি বা ইডিওপ্যাথিক ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া (আইটিপি), যার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। এখানে নিজ দেহের ইমিউন সিস্টেম ভুলবশত রক্তের প্লাটিলেট ধ্বংস করে দেয় (অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি রিয়েকশনের ফলে)।
২. সেকেন্ডারি ইমিউন-থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া, যেখানে প্লাটিলেট কমার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যাবে। যেমন- বিশেষ কোনো ইনফেকশন বা সংক্রমণ (ভাইরাল বা ব্যাক্টেরিয়াল), অটোইমিউন রোগ, রিউমেটিক আর্থ্রাইটিস, ক্যানসার এবং যেকোনো ধরনের ওষুধের কারণে। এমনকি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) ও কোভিড ভ্যাকসিনের ফলেও থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া হতে পারে। তবে তা ডেঙ্গু জ্বরের তুলনায় কম মাত্রায় কমে এবং দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে।
সময়ের ব্যবধানে আইটিপিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. একিউট আইটিপি: প্লাটিলেট আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে।
২. পারসিসটেন্ট আইটিপি: তিন মাসের বেশি সময় ধরে প্লাটিলেট কম থাকলে তা পারসিসটেন্ট আইটিপি। এখানে উপসর্গ কম থাকে।
৩. ক্রনিক আইটিপি: এক বছরের বেশি সময় প্লাটিলেট কম থাকলে তাকে ক্রনিক আইটিপি বলে এবং এটি সাধারণত উপসর্গবিহীন হয়।
ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়ার লক্ষণ
অধ্যাপক এম এ খান বলেন, ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়ার লক্ষণ নির্ভর করে প্লাটিলেট সংখ্যার ওপর। যেমন-
১. রক্তক্ষরণ হওয়া। চামড়ায় কালো কালো দাগ বা লালচে বিন্দু বিন্দু দাগ দেখা দিতে পারে, দাঁতের মাড়ি দিয়ে বা নাক দিয়ে, এমনকি মারাত্মক ক্ষেত্রে প্রস্রাব বা পায়খানার সঙ্গেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে রক্তপাত নির্ভর করে প্লাটিলেটের সংখ্যা ও এর কার্যক্ষমতার ওপর। সাধারণত প্লাটিলেট ২০ হাজারের কম হলে রক্তক্ষরণের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
২. কেটে গেলে বা অস্ত্রোপচারজনিত কারণে রক্তপাত প্রলম্বিত হবে।
৩. মেয়েদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব বেশি হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
৪. সাধারণত জ্বর, কাশি, শরীরে বা জয়েন্টে ব্যথা হয় না। তবে এসব উপসর্গ থাকলে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়ার কারণ আইটিপি না হয়ে অন্যকিছু হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
অধ্যাপক এম এ খান বলেন, ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন রোগের সঠিক ইতিহাস ও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। আইটিপি সাধারণত ডায়াগনোসিস করা হয় থ্রম্বোসাইটোপেনিয়ার অন্য কারণগুলোকে বর্জন করার মাধ্যমে ও রোগের সঠিক ইতিহাস জেনে। প্লাটিলেটের সংখ্যা ও ধরন বোঝার জন্য রক্তের সিবিসি ও পিবিএফ পরীক্ষা খুবই জরুরি। সেইসঙ্গে আরো কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে রোগ নির্ণয়ে।
চিকিৎসা
ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া মারাত্মক রোগ বা ক্যানসার না। প্লাটিলেট ২০ হাজারের কম না হলে সাধারণত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে না। তাই অহেতুক আতঙ্কিত না হয়ে একজন ভালো হেমাটোলজিস্টের পরামর্শমতে চিকিৎসা নিতে হবে এবং ফলোআপে থাকতে হবে।
আইটিপির চিকিৎসা হিসেবে প্লাটিলেট ৩০ হাজারের কম হলে প্রথমত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় দ্বিতীয় লাইনের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। যেমন- এলথ্রোমবোপেগ, রিটুক্সিমেব, প্লীহা অপারেশন ইত্যাদি। পারতপক্ষে প্ল্যাটলেট ট্রান্সফিউশন এড়ানো উচিত ।
অধ্যাপক এম এ খান বলেন, থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া কোনো জটিল রোগ নয়, তবে অনেক সময় তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক সময়ে একজন দক্ষ রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
Comments