ফাগুন হত্যার ৩৩ মাস: নেপথ্যের কাহিনী অজানা, থমকে তদন্ত

১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোর থেকে রাজশাহীগামী একটি ট্রেন থেকে এক নারী সঙ্গীতশিল্পীকে অপহরণের চেষ্টা হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলেই হয়তো বেঁচে যান।
ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। ছবি: সংগৃহীত

১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোর থেকে রাজশাহীগামী একটি ট্রেন থেকে এক নারী সঙ্গীতশিল্পীকে অপহরণের চেষ্টা হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলেই হয়তো বেঁচে যান।

হ্যাঁ, এ দেশে ভাগ্যকে সহায় হিসেবে ধরা ছাড়া আর কী করার আছে। তরুণ গণমাধ্যমকর্মী ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজাকেও এভাবে অপহরণ করা হয়েছিল। তারপর পাওয়া যায় তার মরদেহ, রেললাইনের পাশে। ভাগ্য তার সহায় ছিল না, তাই তাকে মরতে হয়েছিল আততায়ীর হাতে।

আজ ৩৩ মাস হতে চললো ফাগুন রেজা হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া সেখানেই থেমে আছে। তদন্ত চলছে, খুনিদের একজন বাদে সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন বাইরে? এর কোনো উত্তর নেই। ৩৩ মাস উত্তর ছাড়া প্রশ্ন বয়ে চলেছি পিতা হিসেবে। বয়েছি সন্তানের লাশের মতন কষ্টের সবচেয়ে ভারী বোঝা। যার সঙ্গে অন্য কোনো কষ্টেরই তুলনা চলে না। যারা হারাননি তারা সেই বেদনা অনুভবেরও ক্ষমতা রাখেন না। রাখা সম্ভব নয়।

ছেলে ফাগুনের সঙ্গে কাকন রেজা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ রেলওয়ে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি ট্রেনে ভ্রমণ করেন এবং তাকে যদি শত্রুপক্ষ হত্যা করার চিন্তা করে, তাহলে এর চেয়ে সহজ কাজ আর নেই। ট্রেনের কামরায় খুন করে ফেলে দিলেই খেল খতম। খুনের ব্যাপারটি বেমালুম চেপে গিয়ে ঘটনা দাঁড়াবে ট্রেন দুর্ঘটনায়।

ঠিক যেমনটি ফাগুনের ব্যাপারে প্রথমে বলেছিল রেলওয়ে পুলিশ। কিন্তু পরে ক্রমশ বের হতে লাগলো যে এটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। শেষ পর্যন্ত খুনিচক্রের একজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিলো। জানালো তারা ৫ জনে মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু সে ছাড়া বাকি ৪ জন এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।

আগেই বলেছি, কেন হয়নি তার উত্তর নেই। এখন পর্যন্ত শুধু প্রশ্নই হয়ে আছে। ওই ৪ জন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় জানা যাচ্ছে না, এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড কারা। হয়তো ধারণা করা যায়, কিন্তু ধারণাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করবে না আদালত। ধারণা সত্য হলেও প্রমাণ ছাড়া তা শুধুমাত্র ধারণাই।

প্রতিটা দিন আমি গুনে রাখি। প্রতিটা সেকেন্ড মনে থাকে। জানি অব্যবস্থাপনার দেশে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয়। কিন্তু ন্যায়টা ঠিকই হয় একদিন। অবশ্য 'ন্যায়টা ঠিকই হয়' এই কথা বলা কতটা সঠিক, নাকি নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলা, জানি না। কারণ হত্যাকাণ্ডকে এখানে কখনো দুর্ঘটনা, কখনো ছিনতাইকারীদের কাজ, কখনো দস্যুতা— এসব বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে রেললাইনের পাশে যেসব মরদেহ পাওয়া যায়, তার সবই চালানো হয় অপমৃত্যুর নামে। অথচ তার প্রায় প্রতিটিই হত্যাকাণ্ড। খুন।

আমাদের দেশে নুন আর খুন প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। খালে-বিলে, নদী-নালা, রাস্তাঘাট, বনজঙ্গল সবখানেই পাওয়া যাচ্ছে লাশ। এসবের লাশের পরিচয়ও অনেক সময় নিশ্চিত করা যায় না। অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করা হয়। পরিবারের কাছে যারা বেঁচে থাকে নিখোঁজ পরিচয়ে।

ফাগুনের অবস্থায়ও তাই হতে চলেছিল। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের মুহূর্তে তাকে আমরা পাই। এইখানে অন্যদের চেয়ে ভাগ্যবান বলা যায় আমাকে। কারণ, ছেলের শরীরটা অন্তত পেয়েছি। এই গুমের দেশে ছেলের ছবি বুকে বেঁধে অন্যদের মতো মাতম করতে হয় না। অন্তত এটুকু জানি, আমার সন্তান কবরে শায়িত আছে। যে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগ আর অনুযোগের দুহাত তুলতে পারি সৃষ্টিকর্তার কাছে। তার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়াটা করতে পারি।

কী দোষ করেছিল আমার মেধাবী ছেলেটা? গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে সততাকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছিল সে। এই অল্প বয়সেই লোভকে জয় করতে শিখে গিয়েছিল। খবর না করার জন্য উপঢৌকনের নামে উৎকোচ হিসেবে দেওয়া অসৎ অর্থকে নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিয়েছিল ফাগুন। মেধা আর সততাই কী তার জন্য দোষ কিংবা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল? নাকি তার পিতা, যে আমি সবসময় লিখে চলেছি মানুষের পক্ষে, মজলুমের পক্ষে, সেই লেখাই দোষের কারণ হয়ে দাঁড়ালো? জানি না। তদন্ত শেষ হয়নি। সেই উত্তর জানা তাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর তদন্ত শেষেও যে সম্ভব হয়ে উঠবে তার নিশ্চয়তাই বা কে দেবে, দেবে কি? যে দেশে নিজ শয়নকক্ষেও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না, সেখানে নিশ্চয়তার প্রশ্নটিই একটি বড় প্রশ্নবোধক।

ঢাকা থেকে শেরপুর আসার পথে পথিমধ্যে নিখোঁজ হলো ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। একটি গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাব-এডিটর। দেশের গণমাধ্যমের সর্বকনিষ্ঠ সাব-এডিটর ছিল যে। ৩৩ মাস হলো, হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বলা হচ্ছে চলমান, কিন্তু মূলত থেমে আছে। বলেছি তো, কেন আছে তার কোনো উত্তর জানা নেই। কেন নেই, তা জানার অধিকার আছে কি না তাও জানা নেই। কিংবা এ সময়ে জানা থাকতে নেই।

এ দেশে হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, নিখোঁজ মানুষের সন্ধান চেয়ে নামতে হয় সেই রাস্তাতেই। যেমন নেমেছিল ফাগুনের সহকর্মীরা। যেন রাস্তা, রাজপথই হয়ে দাঁড়িয়েছে সব প্রত্যাশার জায়গা, সবকিছুর নিয়ামক। আজকে মানুষকে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে রাজপথে বিলম্বিত বিচারের নামে কিংবা অবিচারের নামে।

কাকন রেজা: লেখক, সাংবাদিক ও নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজার পিতা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments