রাজনীতির চিত্রই কি আমরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দেখছি

শুরুতেই যতটা জোরালোভাবে সম্ভব এটাই বলব যে, একটি খেলা শেষ পর্যন্ত একটি খেলাই। প্রতিটি টুর্নামেন্টই এক একটি ব্যতিক্রমী প্রতিযোগিতার আসর। সেখানে সেরা দল-খেলোয়াড়ের জয় হবে এবং তাদের যোগ্যতা-দক্ষতার প্রতি আমাদের সবার সম্মান দেখানো উচিত।

শুরুতেই যতটা জোরালোভাবে সম্ভব এটাই বলব যে, একটি খেলা শেষ পর্যন্ত একটি খেলাই। প্রতিটি টুর্নামেন্টই এক একটি ব্যতিক্রমী প্রতিযোগিতার আসর। সেখানে সেরা দল-খেলোয়াড়ের জয় হবে এবং তাদের যোগ্যতা-দক্ষতার প্রতি আমাদের সবার সম্মান দেখানো উচিত।

খেলোয়াড়রা তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার মাধ্যমে সেরা হওয়ার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করেন। এ প্রক্রিয়ায় আমরা কিছু বিস্ময়কর মানের ক্রীড়া আয়োজন দেখতে পাই।

তবে, জাতীয়তাবাদ ঢুকে পড়ায় খেলাধুলা হয়ে উঠেছে জাতির জন্য 'গর্ব' বয়ে আনার অবলম্বন। খেলোয়াড়রা নিজেরাই সেই জাতীয়তাবাদের অংশীজন। অর্থ-বিত্ত, খ্যাতির সঙ্গে দেশ-জাতির প্রশংসা উপভোগ করতে শুরু করেন তারা।

স্নায়ুযুদ্ধকালের দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় এ ভাবনা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়। যা শুধু দু'দেশের খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, মতাদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বিতারও বিষয় হয়ে উঠেছিল।

স্নায়ুযুদ্ধের চরম পর্যায়ে ক্রীড়াক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাফল্যকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভাবাদর্শগত সাফল্য হিসেবে প্রচারণা চালানো হতো। সেই মতাদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি এখন আর নেই। কিন্তু, জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি নির্মাণের অংশ হিসেবে খেলাধুলা এখনো জীবন্ত। আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রাণঘাতী 'ঘৃণা উদ্দীপক' হিসেবে ক্ষতিকরও হয়ে উঠেছে।

পারফরমেন্সের জন্য ভারতীয় বোলার মোহাম্মদ শামি ও বাংলাদেশের লিটন দাসের প্রতি এক শ্রেণির দর্শক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং যে লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে, তা জাতীয়তাবাদ ও আদর্শের অনেক বাইরে। বর্ণবাদ খেলাধুলার পুরনো রোগ। এখন এর সঙ্গে যে নতুন ও কপটতাপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হলো ধর্মের অপব্যাখ্যা।

শতবর্ষ না হলেও দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ এর ঘৃণ্য অপব্যবহার রোগে ভুগছে। এখন সেটি আবারও তার সমস্ত ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে ফিরে এসেছে। এটা সব ধরনের খেলাধুলা ও ভক্ত-দর্শকদের জন্যে খুবই দুঃখজনক বিষয়। সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের জন্যে হৃদয়বিদারক।

ক্রিকেটের অস্থিরতা বা ক্রিকেটারদের প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে আক্রমণ, আজকের লেখার মূল বিষয় তা নয়। আমাদের দেশের রাজনীতির চিত্রই যে আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দেখছি, সে বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব এই লেখায়।

আমাদের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে যেকোনো পরিস্থিতিতে ম্যাচ জেতার সক্ষমতাকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে নিজেদের মাঠে পিচ তৈরি করছি একান্তই নিজেদের সুবিধা মতো। রাজনীতিতে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে ভোটারদের আস্থা-সমর্থন অর্জনের পরিবর্তে নিজেরা বিজয়ী হব, তার জন্যে যেমন নির্বাচন দরকার তেমন নির্বাচন আয়োজন করি।

আমাদের ক্রিকেটাররা প্রকৃতপক্ষে কোন অবস্থানে আছেন, সেই সত্যের চেয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে 'জয়ী' হয়ে অতিরঞ্জিত আখ্যান তৈরি করি, যা এক ধরনের কৃত্রিম আত্মবিশ্বাসের সুখানুভূতি দেয়।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আদর্শ পিচে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হলে সেই আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। একইভাবে সত্যিকারের জনসমর্থনের জন্যে নিজেদের রাজনৈতিক দলকে গড়ে তোলার পরিবর্তে আমরা ভয়ভীতি দেখিয়ে, সহিংসতা ও নিপীড়নমূলক আইন দিয়ে সমর্থন ও মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করে ফেলি।

স্পিনবান্ধব ও ধীরগতির পিচে আমাদের ক্রিকেটারদের প্রস্তুতির বিষয়টি যে অত্যন্ত অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল, তা কমবেশি সবাই জানতেন। অন্তত সাংবাদিকরা তো জানতেনই। বিষয়টি নিয়ে তারা ক্রমাগত লিখেছিলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পেস বোলিং সহায়ক পিচের সঙ্গে আমাদের পিচের কোনো তুলনাই চলে না।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পেস বোলিং সহায়ক পিচে খেলতে হবে, তা জানা থাকা সত্ত্বেও আমরা দেশের মাঠে এমন পিচ তৈরি করেছিলাম শুধু এটা বলার জন্য যে, আমরা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি। এমন পিচ তৈরির দায় ক্রিকেটারদের নয়, সম্পূর্ণ বিসিবি পরিচালনাকারীদের।

আমাদের ক্রিকেট বোর্ড পরিচালনাকারীরা হয়ত ভেবেছিলেন, এ বিজয় আমাদের খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস এতটাই বাড়িয়ে দেবে ও তাদের মনোবল এতটাই শক্তিশালী করবে যে, তারা দুর্দান্ত পারফরমেন্স উপহার দেবে। কোনো সন্দেহ নেই, অত্যন্ত দুর্বল ও ভুল ভাবনায় ডুবে ছিল বিসিবি।

পুরো বিষয়টা ছিল অসত্যের প্রলেপে মোড়ানো। তথাকথিত সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি আসলে ছিল একটি সুপরিকল্পিত বিপর্যয়। গর্বের পরিবর্তে এটা আমাদের জন্যে লজ্জা বয়ে এনেছে।

চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমাদের দলের পারফরমেন্স বাংলাদেশের রাজনীতির এমন একটি লক্ষণীয় রূপক তৈরি করেছে যে, চাটুকার ছাড়া এটা কারোরই চোখ এড়াবে না।

মাঝে ২ বছর বাদ দিয়ে গত ৩০ বছর ধরে আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছি। যদিও ওই ২ বছরের একটা বড় অংশ কেটেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্যে, যা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। কিন্তু, এর বদলে আমরা কী দেখেছি?

ক্রিকেট পথ হারিয়েছে ভুল নীতির কারণে, রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। বছরের পর বছর আমাদের নির্বাচনগুলো আরও বেশি বিতর্কিত হয়েছে। ভোটারদের কাছ থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থা পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, আমলাতন্ত্র ও স্থানীয় পেশীশক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে।

বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন একটি মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তবে, আমাদের নির্বাচন কমিশন নিজেকে হাসির পাত্রে পরিণত করেছে। আমাদের নির্বাচন কমিশনের ওপর জনসাধারণের সামান্যতম আস্থাও অবশিষ্ট নেই। আস্থাহীনতার বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জনগণ তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মান সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছে।

নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের কাজ কি শুধুই কিছু লজিস্টিক সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ? তাদের বিষয়ে জনগণের যে ধারণা, তার কী হবে? ভোটাররা তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কী ভাবছেন, তা নিয়ে তাদের কি জরিপ করা উচিত ছিল না?

যদি তারা এমন কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে এর ফলাফল জানতে পারলে আমরা খুশি হব। নির্বাচনী বিরোধের নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। কখনো কখনো নির্বাচিত সংসদের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়, বিরোধ নিষ্পত্তি হয় না।

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ভোটারদের সচেতনতামূলক শিক্ষাবিষয়ক কিছু নেই। ভোটারদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, গণতন্ত্রের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানানোর বিষয়টি আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় অনুপস্থিত।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলছে। এখানে আমরা যা দেখছি, তা হচ্ছে সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রতিযোগিতা। আমরা কি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আমলাতান্ত্রিক দমন-পীড়ন শিথিল করার ব্যাপারে কিছু শুনেছি?

ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের মতো সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। কিন্তু, তারা সবাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে কাজ করেন। যাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা আছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করছেন আমলারা। জনরায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বা পারবেন না, তা নির্ধারণে আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।

গণতন্ত্রের একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সংসদ। সম্মানের সঙ্গে বলছি, সংসদে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে বিতর্ক হয় কিনা সে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। যদি আমাদের সংসদ করোনা মহামারি বা জলবায়ু বিপর্যয়কে কোনো বিশেষ অধিবেশন ডেকে বিতর্কের জন্য বিবেচনা করতে না পারে, তাহলে কোন বিষয়টি তাদের হৃদয় ও মনকে নাড়া দেবে, তা আমার জবাব দেওয়ার ক্ষমতার বাইরের একটা প্রশ্ন। আদর্শিক বা জনকল্যাণভিত্তিক আলোচনাকে আমরা গুরুত্বের মধ্যে আনছি না। নিজেদের সুবিধার বিষয়গুলোই শুধু বিবেচনায় রাখছি।

ক্রিকেটেও নিজেদের মাঠের পিচ এমনভাবে তৈরি করি, যাতে বাইরের দলগুলো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে। নিজেদের সাময়িক সুবিধার জন্যে যে বড় বিপর্যয় ডেকে আনছি, তা স্মরণে রাখছি না। যে পিচের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমরা আমাদের বোলারদের প্রশিক্ষণ দিই, ম্যাচ জিতি এবং ঘোষণা দিই, আমরা বিশ্বকে মোকাবিলায় প্রস্তুত; পরে এমন একটি দলের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই হেরে যাই, যাদের হারানো প্রত্যাশিত ছিল।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল কি খারাপ খেলেছে? হ্যাঁ, তবে তারা জেতার উপযোগী যোগ্য দল ছিল না। ভ্রান্ত পদ্ধতি অনুসরণের ভুল প্রস্তুতিতে ক্রিকেট দল বাস্তবতা বিবর্জিত কাল্পনিক আশা জাগিয়েছিল। একই রকম চিত্র দৃশ্যমান আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাতেও।

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাও ঠিক যেন এমনই। নির্বাচনী ফলাফলে সত্য বলে যা প্রকাশিত হয়, তা যে প্রকৃত সত্য নয়, তা প্রায় সবারই জানা। এই সত্য সবচেয়ে বেশি জানেন তারা, যারা 'বিজয়ী' হয়ে জনগণের সামনে হাজির হন। এই বিজয়ীরা সত্য বলার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। ফলে সমাজ থেকে সত্য নির্বাসিত হতে থাকে। তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু নিজেদের সুবিধার বিষয়গুলো নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে থাকেন।

জেনেছি, সব স্বাগতিক দলই নিজেদের মতো করে পিচ বানিয়ে সুবিধা নেয়। সুতরাং, আমরাও সেই কাজটা করলে অসুবিধা কী? অসুবিধা যে কী, তার প্রমাণ তো আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পেলাম। ক্রিকেটের এই শিক্ষা কি আমাদের রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে?

ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিয়ে আমরা বুঝতে পারছি, ভুল পথে আছি। রাজনীতিতেও যে আমরা ভুল পথে আছি, তা কি আমাদের উপলব্ধিতে আসবে? রাজনীতির ক্ষেত্রে, আত্মশুদ্ধির একমাত্র উপায় হলো সঠিক সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আসরে সাফল্য পেতে আদর্শিক পিচে প্রস্তুতি নেওয়া অপরিহার্য। সঠিক পথের রাজনীতি ও আদর্শিক গণতন্ত্রের জন্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Dos and Don’ts during a heatwave

As people are struggling, the Met office issued a heatwave warning for the country for the next five days

1h ago