সহস্র দেয়ালে ফাটল

দেশজুড়ে সহস্র দেয়ালে ফাটল। বিভিন্ন জেলায় ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ার শব্দ। এতো শুধু দেয়াল নয়, গৃহহীনদের স্বপ্ন ভাঙ্গার শব্দ। অনিয়ম দুর্নীতির কোন পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি যে আমাদের তৈরি করা বাড়ির পাকা দেয়াল ভেঙ্গে পড়ছে নির্মাণের ছয় মাসের মধ্যেই। এই দেয়াল ভেঙ্গে পড়ার শব্দ কি রাষ্ট্রের জন্য ঘুম ভাঙার ডাক নয়?
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে তৈরি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ১১টি ঘর জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

দেশজুড়ে সহস্র দেয়ালে ফাটল। বিভিন্ন জেলায় ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ার শব্দ। এতো শুধু দেয়াল নয়, গৃহহীনদের স্বপ্ন ভাঙার শব্দ। অনিয়ম দুর্নীতির কোন পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি যে আমাদের তৈরি করা বাড়ির পাকা দেয়াল ভেঙে পড়ছে নির্মাণের ছয় মাসের মধ্যেই। এই দেয়াল ভেঙে পড়ার শব্দ কি রাষ্ট্রের জন্য ঘুম ভাঙার ডাক নয়?

নির্মাণাধীন ঘরের ইট ও গাঁথুনীতে সকাল-সন্ধা পানি ঢেলেছেন বরগুনার তালতলীর সীমা রানী। সেই ঘরের পিলার ভেঙে পড়েছে। এই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সীমা রানী যখন বলেন, ‘এ ঘরে আমি থাকবো কেমন করে? আমার থাকার কোনো দরকার নেই।’ সেই কান্নার শব্দ কি আমরা শুনছি? রাষ্ট্র কি শুনছে?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্র তার গৃহহীন নাগরিকদের বসতঘর দিয়েছে। সারাদেশে ছেষট্টি হাজার গৃহহীন পরিবারের একদিনে ঘর পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য আনন্দদায়ক ঘটনা। কিন্তু আনন্দ স্থায়ী হয়নি। কয়েকমাস না যেতেই পাকা দেয়ালের সেই ঘর ভেঙে পড়ছে।

এদেশের মানুষ মাটির দেয়ালের ঘরেও বাস করেন। তারা যদি এখন রজনীকান্ত সেনের কবিতার লাইনের সাথে দ্বিতীয় একটি লাইন যোগ করে নেন, “নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা/ সরকারি পাকা ঘর শুধুই তামাশা।” তাহলে কি তাদের খুব দোষ দেয়া যাবে? কারণ মাটির দেয়ালের ঘরে মানুষ অনায়াসে দশ বছর বাস করতে পারে। আর পাকা ঘর ভেঙে পড়ছে ছয় মাসের মধ্যে। শুধু একটি উপজেলায় নয়, একটি জেলায় নয়- অনেকগুলো জায়গায় একই ঘটনা ঘটছে। এতে ধারণা করা যায়, সারাদেশে এই প্রকল্পের সার্বিক কাজের মান কী।

বিভিন্ন সূত্রের খবর, দেশে একেবারে গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা নয় লাখ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেছেন, সবার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা হবে। প্রথম পর্যায়ে দেশের প্রায় পাঁচশ উপজেলার ছেষট্টি হাজার পরিবারকে একদিনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে মাথাগোঁজার ঠাঁই। প্রত্যেক পরিবার পেয়েছে দুই শতাংশ জমির মালিকানাসহ সেমি-পাকা ঘর। প্রতিটি ঘরে দুটি শয়নকক্ষ ছাড়াও রয়েছে বাথরুম ও রান্নাঘর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরের মধ্যে আরও এক লাখ পরিবারকে ঘর দেয়ার পরিকল্পনার কথা সরকার জানিয়েছে। সব মহলের সাধুবাদ পেয়েছে সরকারের এই উদ্যোগ।

এমন একটি মহতী উদ্যোগকে এমন তামাশায় পরিণত করলো কারা? সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তারা, ঠিকাদাররা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ নেতারা সাধারণত জড়িত থাকেন। যারা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা তো জানতেন এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের স্মারক প্রকল্প। সরকার এটিকে বলছে, গৃহহীনদের জন্য “প্রধানমন্ত্রীর উপহার”। সেই প্রকল্পেরই এই অবস্থা! তার মানে কি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারকেও তারা হেলাফেলা করছেন? তারা ধরেই নিয়েছেন কিছুতেই কিছু হবে না।

রাস্তা কার্পেটিংয়ে লোহার রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার, ব্রিজ চালুর আগেই ভেঙ্গে পড়া এসব তো আমরা কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি। সেসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে আজকে এতোবড় ঘটনা হয়তো ঘটতো না। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্টে সোনার বারো আনাই নকল ছিল। সেই খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কয়েক বছর আগেই। রাষ্ট্রের জন্য এতোবড় লজ্জা যারা বয়ে এনেছিলেন, বছরের পর বছর তদন্ত হলেও সরবরাহকারীদের নামে মামলা হওয়া ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সুতরাং, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন। এমন সব উদাহরণ সামনে থাকলে দুর্নীতি যারা করেন, তাদের মনের জোর বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

এবারের প্রতিটি ঘরের জন্য বাজেট পৌনে দুই লাখ টাকা। কোথাও কোথাও গরীব মানুষের কাছ থেকে এ বাবদ স্থানীয় নেতারা কেউ কেউ টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ফরিদপুরের একটি প্রকল্পে ঘরপ্রতি পঁচিশ হাজার টাকা করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বাস্তবায়নে দায়িত্বরত অনেকেই এখন টিভি সাক্ষাৎকারে, বলার চেষ্টা করছেন বাজেট কম। তাই কাজের মান খারাপ। কম বাজেটের কথা বলে পার পাওয়ার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। কম বাজেট হলে কি সেই কম টাকাটা জলে ফেলে দিতে হবে? “সরকারি মাল, দরিয়ামে ঢাল” বলে নষ্ট করতে হবে?

অথচ মাত্র বছর দেড়েক আগে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা টিনের ঘরের জন্য বরাদ্দ অর্থ দিয়ে সেমিপাকা ঘর করে দিয়েছিলেন ঘরহীনদের। ঝিনাইদহের শৈলকূপার তৎকালীন ইউএনও মো. ওসমান গণি এই কাজটি করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। শৈলকূপা উপজেলায় সেবছর ৩০৯টি ঘরের জন্য ৩ কোটি ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ যায়। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ এক লাখ টাকা। পাকা ভিটির ওপর টিনের বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে নির্দিষ্ট মাপে এই ঘর করার নির্দেশনা ছিল। এই টাকা দিয়েই নির্দেশিত টিনের ঘরের বদলে স্থানীয় প্রশাসন একই মাপের সেমি-পাকা ঘর করে দেয়। অর্থাৎ ঘরের টিনের বেড়ার বদলে পাকা দেয়াল করে দেন তারা। সেইসব ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ার কোনো খবর আসেনি।

সততা, স্বচ্ছতা ও নাগরিকদের জন্য ভালো কিছু করার যে দৃষ্টান্ত মো. ওসমান গনি স্থাপন করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা তার সহকর্মীরা রাখতে পারলেন না। বরং এমন বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যাতে সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তাদের অনেক ভালো কাজ ঢাকা পড়ে যাবে। কারণ সাম্প্রতিক ঘটনা সার্বিকভাবে রাষ্ট্র, সরকার ও তার পদাধিকারিকদের সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ ধারণা দিলো।

এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজনকে ইতোমধ্যে ওএসডি করা হয়েছে। ঘরভাঙ্গার, দেয়াল ফাটার, বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে থাকে এমন জায়গায় ঘর করার যেসব সচিত্র অভিযোগ বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে, তাতে আরো অনেককেই এই পরিণতি বরণ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন। আমরা প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে চাই।

তবুও, একই সাথে সম্প্রতি বহুল আলোচিত একটি ঘটনার তদন্তের কথাও মনের মধ্যে উসখুস করে। নারায়ণগঞ্জের একজন ইউএনও কর্তৃক একজন সহায়তাপ্রার্থী দরিদ্র মানুষকে উল্টো ১০০ জনকে সহায়তা করতে বাধ্য করার ঘটনারও তদন্ত হয়েছে। দেখা গেছে, রায় প্রদানকারী কর্মকর্তার এতে কোনো দায় নেই। দোষী শুধুমাত্র ইউপি সদস্য।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘর নিয়ে দেশব্যাপী ঘটে যওয়া ঘটনাগুলোর বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলাই সমীচীন হবে।

এসব তদন্ত ও বিচারে সরকারি কর্মকর্তাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ “সরল বিশ্বাস”-এর ক্লজ। ধরুন, দেখা গেলো সবাই যা করেছেন, তথাকথিত “সরল বিশ্বাস”-এ করেছেন। জেনেবুঝে কেউ কোনো দুর্নীতি, অনিয়ম করেননি। তাহলেই কি সবাই দায়মুক্তি পাবেন? দেয়াল যে ভেঙে পড়লো, নলকূপে যে পানি উঠলো না, সারাবাড়ি যে ধানিজমিতে পানি ওঠার সাথে সাথে তলিয়ে গেলো, রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হলো, সরকার নাগরিকের কাছে মুখরক্ষা করতে পারলো না -- এসবের দায় তাহলে কার? শুধুই সরল বিশ্বাস বলে দিলেই হবে?

যদি তেমন কিছু শেষমেষ দেখা যায় তাহলেও খুব অবাক হবো না। কারণ, ঢালাইয়ে বাঁশ এসব তো চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন সেখানেও রাখতে হবে, যার বা যাদের সরল বিশ্বাসের কারণে দেশের ক্ষতি হয়, হাজার হাজার মানুষের কান্নার কারণ হয়, সরকার ইমেজ সংকটে পড়ে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সেইসব দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ওই পদের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বা যোগ্যতা আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেবে?

একই সাথে, এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে যেসব ঘর তৈরি হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে এরকম যেন না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য দরকার হলে পরিকল্পনা গ্রহণের ধাপ থেকে শুরু করে উপকারভোগীর কাছে হস্তান্তর পর্যন্ত প্রতিটি ধাপকে পুনর্বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করতে হবে। আর এবারের ছেষট্টি হাজার উপকারভোগী যেনো নিশ্চিন্তে বসবাসের মতো মজবুত একটি করে ঘর পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো রকমে মেরামত করে আবার বছরখানেক পরে ভেঙ্গে পড়বে এরকমটি যেনো না হয়, সেই খেয়াল রাখতে হবে।

এমনিতেই বালিশ কেলেঙ্কারী, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় কেলেঙ্কারী ইত্যাদি নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট দুর্নাম হয়েছে। এই ঘটনা সেটিকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। এখন দেখার বিষয়, সরকার এই ঘর কেলেঙ্কারীতে –দায়ীদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয় এবং উপকারভোগীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে কী পদক্ষেপ নেয়।

তাপস বড়ুয়া, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
  July massacre victims

Dubious cases are an injustice to July massacre victims

Legal experts opined that there should be a judicial investigation into these cases.

9h ago