ক্রয় ক্ষমতা কমছে, টিসিবির ট্রাকে লাইন বাড়ছে

গতকাল দুপুরে রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে থেকে তোলা। ছবি: আমরান হোসেন

ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার আশায় গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফার্মগেটে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন হালিমা খাতুন।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও ৭০ বছর বয়সী হালিমার ভাগ্যে সেদিন কিছুই জোটেনি। শুধু একদিনের ঘটনা নয় এটি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টানা ৮ দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেননি তিনি।

কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় টিসিবির ট্রাকের মাধ্যমে খোলা বাজারে বিক্রি করা (ওএমএস) পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে লাইন শেষ হওয়ার আগেই পণ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে।

হলিমা বলেন, 'আমি লাইনের সামনে পৌঁছানোর আগেই সব পণ্য বিক্রি হয়ে যায়।'

৪ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম সদস্য হালিমা ৩টি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। এসব কাজের মাঝখানেই সময় বের করে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়ান তিনি।

হালিমা মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করেন। এর ৪০ শতাংশই বাড়ি ভাড়া পরিশোধে চলে যায়।

টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টিসিবির ট্রাকের জিনিসগুলো বাজারের তুলনায় সস্তা। তাই আমি এখান থেকে কিছু জিনিস কেনার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশিরভাগ দিন আমাকে খালি হাতে ফিরতে হয়।'

হালিমার মতো আরও অনেক দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষ ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন প্রতিদিন। কারণ করোনা পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তাদের আয় কমে গেছে।

গত এপ্রিলে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে দেখা গেছে, মহামারি দেশের ২ দশমিক ৪৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর অর্থ, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। মহামারির আগে দেশে দরিদ্র ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কমে যাওয়ার পর লোকজন আবার কাজে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে এসব কাজ নিম্নমানের এবং আগের তুলনায় তারা কম বেতন পাচ্ছেন।  

এর মধ্যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়ার কারণে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায়, গত কয়েক সপ্তাহে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দীর্ঘ এখন।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েলের দাম গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ডালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের মতো। গত মাসে পেঁয়াজের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

ওএমএসের আওতায় নিম্ন-আয়ের মানুষ ১ লিটার সয়াবিন তেল ১০০ টাকায় কিনতে পারছেন। এ ছাড়া, ৫৫ টাকা কেজি দরে চিনি, ৫৫ টাকা কেজি দরে ডাল এবং ৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনতে পারছেন তারা।

গত ১৪ অক্টোবর কাঁচাবাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৬৫ টাকা। প্রতি কেজি  চিনির দাম ছিল ৭৯ টাকা। ডাল ও পেঁয়াজের দাম ছিল যথাক্রমে ৮৫ টাকা ও ৬০ টাকা কেজি।

টিসিবর ট্রাক থেকে একজন সর্বোচ্চ ২ লিটার তেল, ৪ কেজি পেঁয়াজ, ২ কেজি চিনি এবং ২ কেজি ডাল কিনতে পারেন।

২০১৯ সালে সরকার ১৮০টি ট্রাকে ভর্তুকিযুক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে। মহামারিতে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হওয়ার কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ২০২০ সালে ট্রাকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০টি করা হয়।

টিসিবির তথ্য মতে,  এখন ট্রাকের সংখ্যা বেড়ে ৪৫০ এ দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি ট্রাকের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কেজি পণ্য বিক্রি হয়।

গত রোববার রাজধানীর মিরপুরের গৃহকর্মী ফাহমিদা আক্তারকে ৫ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।

ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি  মিরপুরের সনি সিনেমা হলের সামনে ট্রাকের লাইনে দাঁড়ান। দুপুর ২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কিছু কিনতে পারেননি।  

ফাহমিদা বলেন, 'আমি এখানে প্রথমবার এসেছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় অসহায় হয়ে পড়েছি। আর কোথায় যাব? বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে পারছি না।'

মিরপুরের বাসিন্দা শিউলি আক্তার নিয়মিত ট্রাক থেকে নিত্যপণ্য কিনে থাকেন। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় তিনি বলেন, তাকে প্রায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।  

বেবি আক্তার নামের এক  নারী রিকশাচালকও রোববার  নিউ মার্কেট এলাকায় টিসিবর ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার পালা আসার আগেই আগেই পণ্য শেষ হয়ে যায়।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'মহামারিজনিত কারণে অনেক মানুষ যে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে গেছে, এ দীর্ঘ লাইন তার প্রমাণ। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় তাদের দুর্দশা আরও বেড়েছে।'

সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ এবং সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

মিরপুর বাংলা কলেজের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করেন টিসিবির ডিলার সুমাইয়া তানিশা এন্টারপ্রাইজের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, 'টিসিবির পণ্যের চাহিদা ব্যাপক। এ জায়গায় প্রতিদিন ৫ হাজার কেজি পণ্যের চাহিদা আছে। কিন্তু আমরা মাত্র ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ কেজি পণ্য বিক্রি করি। টিসিবি কর্তৃপক্ষকে চাহিদার কথা জানিয়েছি।'

কিছু নিয়মিত গ্রাহক অভিযোগ করেন, যেসব স্থানে এসব পণ্য  বিক্রি হয়, সেখানে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে।

সিন্ডিকেটের সঙ্গে লোকজন ওএমএস থেকে কম দামে পণ্য কিনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন বলে জানান একজন।

টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবিরও  ঢাকা বিভাগে এমন সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, 'প্রতিটি গ্রুপ ৩০ জনের। তারা টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করেন। আমরা ঘন ঘন স্পট পরিবর্তন করি, যাতে সিন্ডিকেটগুলো কাজ করতে না পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেক মানুষ যে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে এবং পণ্য না পেয়ে ফিরে যায়, তা আমাদের জানা আছে।'

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, টিসিবির ওএমএস পরিচালনার জন্য ২০২১ অর্থবছরে সরকার ৯৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ২০২০ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল ৮৭৬ কোটি।

২০২২ অর্থবছরের জন্য এ বাবদ সরকার ১ হাজার ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে জানা গেছে।  

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Pathways to the downfall of a regime

The erosion in the credibility of the Sheikh Hasina regime did not begin in July 2024.

9h ago