বগুড়ার কাঁচের শিশি তৈরি শিল্প বিলুপ্তপ্রায়
তিন চার বছর আগেও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শিহরী এবং ডুমরি গ্রামের প্রায় ৪০০ বাড়ি মুখর থাকতো হাঁপড়ের গরম বাতাস এবং ছোট ছোট কারখানায় হাজারো মানুষের কর্মচাঞ্চল্যে। দুই-তিন হাজারের বেশি নারী পুরুষ এসব কারখানায় তৈরি করতেন কাঁচের শিশি, যা স্থানীয় বাজারসহ চলে যেত দেশের বড় শহরগুলোতে। হোমিওপ্যাথি ওষুধ এবং রেক্টিফাইড স্পিরিট সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো এসব কাঁচের শিশি।
কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, প্লাস্টিকের বাজার দখল এবং বড় কারখানায় আমদানিকৃত অটোমেশিনে কাঁচের শিশি তৈরি হওয়ার কারণে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই দুই গ্রামের শিশি কারখানা। মালিকরা অনেকে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন। শ্রমিকরা জীবিকার তাগিদে পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন।
বেসরকারিভাবে শুরু হওয়া বগুড়ার এই কাঁচ শিল্পের বিলুপ্তির আরও একটি বড় কারণ সরকার থেকে এই উদ্যোক্তারা কোনো ঋণ পাননি, কোনো কারিগরি সহায়তাও জোটেনি। ফলে হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের স্থানীয় শিল্পটি হারিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় ৪৫-৫০ বছর আগে কুমিল্লা থেকে এক ব্যক্তি শিহরী গ্রামে আসেন। শিহরী গ্রামে তিনিই প্রথম গড়ে তোলেন একটি কাঁচের শিশি তৈরির কারখানা। এর পরে শিহরী গ্রামের প্রায় ২০০টি বাড়িতে তৈরি হতে থাকে এই কাঁচের শিশি। ব্যবসা ছড়িয়ে পরে পাশের ডুমরি গ্রামেও। সেখানেও প্রায় ২০০ উদ্যোক্তা নিজ বাড়িতে এই ব্যবসা শুরু করেন।
কাঁচামাল হিসেবে এই শিল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে আনা হতো শত শত ট্রাক কাঁচের পাইপ। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, খুলনা, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন শহরে যেত দুই গ্রামের উৎপাদিত পণ্য। দুই গ্রাম থেকে বছরে শিশি বিক্রি হতো প্রায় ১০০ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে গ্রামবাসীদের কাছে এখন সবই স্মৃতি হয়ে গেছে।
সম্প্রতি দুই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখন বাড়িতে বাড়িতে এই শিল্পের যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে আছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে পরিত্যক্ত স্থানে পড়ে আছে হাজারো ভাঙা কাঁচের শিশি। অনেকদিন ধরে বন্ধ আছে ২০-৫০ জন শ্রমিকের এই শিশি তৈরির কারখানাগুলো।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই এফ) ক্লাস্টার ম্যাপিং এক স্টাডিতেও উঠে আসে এই শিল্পের কথা। সেখানে বলা হয়, ১৯৭২ সালে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শিহরী গ্রামে প্রথম শুরু হয় এই কাঁচের শিশি তৈরি। ১০০টি কারখানায় ৪০০ জন দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক এখানে কাজ করতো। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে ২০ শতাংশ এবং ৮০ শতাংশ যেত সারাদেশের বাজারগুলোতে। এই গ্রামে তখন বছরে ৫০ লাখ টাকার কাঁচের শিশি তৈরি হতো, জানা যায় এসএমই এফ’র সেই জরিপে।
তবে, এসএমই এফ’র জরিপে কেবল একটি গ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের পরেও এই ব্যবসার প্রচার ঘটেছিল। অনেক ব্যবসায়ী ২০১৭-১৮ সালের দিকেও অনেক মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই জরিপে আরও বলা হয় যে, শিল্প হয়তো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, আর্থিক কোনো সহায়তা না পাওয়া এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা না পাওয়ার জন্য। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, এত তাড়াতাড়ি এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা তারা ভাবতেই পারেননি।
দুই গ্রামের উদ্যোক্তারা এই শিল্প বাঁচাতে একটা সময় শুধু নারী শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলেন, যাদের বেতন পুরুষদের তুলনায় অর্ধেক ছিল। উৎপাদন খরচ কমাতে তারা এটা করেছিলেন, কিন্তু তবুও বাঁচাতে পারেননি এই শিল্প, বলছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
ডুমরী গ্রামের আব্দুল জলিল (৫৮) বলেন, ‘পাঁচ বছর আগেও শিহরী এবং ডুমরী গ্রামে ৪০০ পরিবারে হতো কাঁচের শিশি তৈরির কাজ। দুই গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ছিল শিশি তৈরি, বাজারজাত করার কর্মতৎপরতা। কিন্তু এখন শিহরী গ্রামে মাত্র দুই থেকে তিনটি বাড়িতে সীমিত আকারে কাঁচের খেলনা তৈরি করা হচ্ছে। বাকিরা অন্য পেশা গ্রহণ করেছেন।’
‘ডুমরী এবং শিহরী গ্রামে ছোট-বড় ৪০০টি কারখানায় প্রায় দুই-হাজার নারী পুরুষ এই কাঁচের শিশি তৈরি করতেন। পাঁচ বছর আগেও ভালো আয় করেছেন সবাই। পরে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে শুধু নারী শ্রমিকরা বাড়িতে শিশি তৈরির কাজ শুরু করেন’, বলেন ডুমরী গ্রামের বাচ্চু মণ্ডল (৪০)।
ডুমরি গ্রামের আরেক যুবক জাহিদ হাসান (২৭), যার বাবা ২০০২ সালে এই গ্রামে তিনটি কাঁচের শিশি তৈরির কারখানা দিয়েছিলেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেই কারখানাগুলো চালু ছিল। জাহিদের কারখানায় দিনে ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। প্রত্যেক সপ্তাহে সেই শ্রমিকদের মজুরি ছিল ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। এখন সেই কারখানা, শ্রমিক কিছুই অবশিষ্ট নেই।
জাহিদ হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ছয়-সাত বছর আগেও আমাদের ব্যবসা ভালো ছিল। মাসে ৫০ হাজার টাকা লাভ করতাম। কিন্তু অটোমেশিন আর প্লাস্টিক বোতলের কারণে আমাদের কারখানার প্রোডাক্ট বাজারে ধরা খেল। সব বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। এখনো বাজারে আমাদের ছয়-সাত লাখ টাকা আটকে আছে। অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।’
নশরতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামছুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শিহরী এবং ডুমরী গ্রামের কাঁচের বোতলের শিল্প তিন-চার বছর আগেও জমজমাট ছিল, কিন্তু উৎপাদনে বেশি খরচ আর লাভ না হওয়ার জন্য এই শিল্প এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। এই উদ্যোক্তারা সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি।’
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘২০১৩ সালে যে ক্লাস্টার ম্যাপিং করা হয়েছিল, সেই হিসাবে দেশে ১৭৭টি ক্লাস্টার ছিল। এদের মধ্যে অনেকগুলো ক্লাস্টার ইতোমধ্যে বিলুপ্তির পর্যায়ে চলে গেছে। এখন আমরা সামনের অর্থবছরে আবার সারাদেশে এসএমই ক্লাস্টার ম্যাপিং করব।’
বগুড়ার গ্লাস বোতল ক্লাস্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শিহরী ক্লাস্টার ছিল একটা নন-বুস্টার ক্লাস্টার। ক্লাস্টারটির আধুনিকায়ন না হওয়া এবং কোনো পক্ষ থেকে সাহায্য না পাওয়ার কারণে হয়তো বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের তখন আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে আমরাও সহযোগিতা করতে পারিনি’, বলেন মফিজুর রহমান।
তবে, আর্থিক সামর্থ্যের দিক দিয়ে এখন আমরা অনেক উন্নতি করেছি। আশাকরি- এই ধরনের ক্লাস্টারগুলোকে আমরা এখন সাহায্য করতে পারব।
এ বিষয়ে বগুড়া বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক এ কে এম মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বর্তমান বাজারে টিকে থাকতে না পেরে কালের বিবর্তনে হয়তো কাঁচের বোতল শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে, খুব শিগগির আমরা সেখানে যাব। উদ্যোক্তাদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করব। তারা যদি ঋণ বা ট্রেনিং চান, সেই বিষয়েও সাহায্য করতে পারব আমরা। আর যেসব উদ্যোক্তা পুঁজি হারিয়েছেন, তারা যদি অন্য কোনো ছোট শিল্পের উদ্যোক্তা হতে চান, তাহলে সেই পুনর্বাসনে আমরা সাহায্য করব’, বলেন মাহফুজুর রহমান।
Comments