১২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে

আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে গত ১২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। গতকাল সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে এই তথ্য জানা গেছে।
ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ১১ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে সেপ্টেম্বরের ৫ দশমিক ৫৯ থেকে নভেম্বরে ৫ দশমিক ৭০ হয়েছে। টানা তিন মাস ধরে এই সূচক বাড়ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
সাধারণ মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে খাদ্য বর্হিভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি, যেটি অক্টোবরে গত ৬২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল।
খাদ্য বর্হিভূত মূল্যস্ফীতি গত মাসে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে, যেটি এর আগের মাসে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ এর আগস্টে এই সূচকের মান ৭ শতাংশ ছিল। এর পর এবারই প্রথম খাদ্য নয়- এমন পণ্যের মূল্যস্ফীতি এতটা বাড়লো।
করোনাভাইরাস পরবর্তী চাহিদা পুনরুদ্ধার, নজিরবিহীন শিপিং চার্জ এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে বৈশ্বিক বাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে এবং এর প্রভাবে বাংলাদেশের মতো আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।
উদাহরণ হিসেবে একজন বিশ্লেষক জানান, ইউরোপের বন্দরগুলো থেকে চট্টগ্রামে একটি ৪০ ফুট লম্বা কন্টেইনার আনার জন্য ফ্রেইট চার্জ এখন প্রায় ১৫ হাজার মার্কিন ডলার, যেটি এক বছর আগেও দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ডলারের মধ্যে ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বন্দরগুলোতেও রপ্তানির ক্ষেত্রে ফ্রেইট চার্জ গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেড়েছে। আমদানির ক্ষেত্রেও এই খরচ সাম্প্রতিক কালে ২ গুণ হয়েছে।
তবে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয় যেখানে উচ্চ পর্যায়ের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
এমন কি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার অক্টোবরে বেড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। এর আগের ৩ দশকে দেশটিতে একবারের জন্যেও এত উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি।
যুক্তরাজ্যে গত ১ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৪ দশমিক ১ শতাংশ, যেটি গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জ্বালানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ার প্রভাবে অক্টোবর মাসে ফ্রান্সে ২০০৮ এর পর সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৬ শতাংশ বার্ষিক মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে। একই সময়ে চীনের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিইডব্লিউ ৪৬টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছে ৩৯টি দেশে ২০২১ এর ৩য় প্রান্তিকের মূল্যস্ফীতির হার মহামারির আগে ২০১৯ এর ৩য় প্রান্তিকের মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ে গেছে। ১ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ২২ শতাংশে পৌঁছেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে স্থিতিশীল স্থানীয় উৎপাদন ও উচ্চ মাত্রায় আমদানি হওয়া সত্ত্বেও চালের দাম কমেনি, যেটি খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার মূল কারণ। একইভাবে, সয়াবিন তেল ও চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণের দামও বেড়েছে। এছাড়াও, বাজারে শীতের শস্য আসা সত্ত্বেও সার্বিক ভাবে সবজির দামও কমেনি।
বিবিএসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে পল্লী অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ৪ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ হয়েছে ও শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে কারণ হিসেবে বাড়তে থাকা চাহিদা ও খরচ, উভয়ের কথাই বলেছেন।
তিনি বলেন, 'ভাইরাস সংক্রমণের হার ক্রমাগত কমার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসছে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাহিদাও বাড়ছে। এতদিন চাপা থাকা চাহিদা হঠাৎ করে প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি খুব সম্ভবত সাময়িক।'
নভেম্বরের ৪ তারিখে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর কারণে ইতোমধ্যে জনসাধারণ ও পণ্যের পরিবহন খরচ বেড়েছে, যার প্রভাবে আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি খরচ বাড়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) লোকসানের মুখে পড়ে। এই লোকসান পূরণের উদ্দেশ্যে সরকার জ্বালানি খরচের সমন্বয় করে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত জ্বালানির দাম বাড়ানোর ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
জাহিদ জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে আসছে, কিন্তু ডিজেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং এর ফলশ্রুতিতে পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনও সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপর পড়েনি।
'তাই আগামী কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলেও আমি বিস্মিত হবো না', বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন পাম তেল, সয়াবিন তেল ও গমের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়।
জাহিদ বলেন, 'বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এসব পণ্যের আমদানি মূল্য নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং কমতে থাকা মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় বাজারের মূল্যকেও নামিয়ে আনতে হবে।'
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান মূল্য নিয়ন্ত্রণের চর্চা থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল এসেছে কী না, তা যাচাই করে দেখতে।
তিনি বলেন, 'আমরা পণ্যের মূল্যের ব্যবস্থাপনা করতে চেয়ে থাকলেও সেটার জন্য একটি ফর্মুলা ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত, যাতে সব ধরনের মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ হয় এবং আমলাদের ফায়দা নেওয়ার সুযোগ সীমিত থাকে।'
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments