বর্ণময় জীবনের সমাপ্তিও যেন আরেকটি ফ্লিপারে!

Shane Warne
ছবি- সংগ্রহ

'ক্রিকেট সব সময়ই আমার এক নম্বর প্রাধান্যের বিষয়। এর মানে এই না যে আমি আমার পরিবারকে মূল্য দিচ্ছি না। কিন্তু পরিবার দ্বিতীয়তে থাকবে।'- তাকে নিয়ে বানানো প্রামাণ্যচিত্র 'শেন' এর এক জায়গায় এমনটাই বলেছিলেন শেন ওয়ার্ন। অবিশ্বাসের সাগরে গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে ভাসিয়ে চিরবিদায় নেওয়া এই কিংবদন্তির ৫২ বছরের জীবনটা ছিল বর্ণময়, ঘটনাবহুল।

রহস্যমাখা লেগ স্পিনের মায়াজালে মাত করে রাখা এই লেগ স্পিনার ডেলিভারি দিয়ে যেমন তাক লাগিয়ে দিতেন, তার চলে যাওয়াও হয়ে থাকল হতভম্ব করে দেওয়া। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হুট করেই, যেন আরেকটি ফ্লিপার!

কোন আভাস ছিল না। মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগেই আরেক অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রডনি মার্শের বিদায়ে টুইট করেছিলেন, শোক-শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সমস্ত খবরের আলো তার উপর। বিশাল এক শূন্যতার হাহাকার তৈরি করে অসীমের পথে পাড়ি দিলেন যে কেবল ৫২ বছর বয়েসে।

১৯৬৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার জন্ম ওয়ার্নের। সমাপন হলো থাইল্যান্ডের এক দ্বীপে, একদম একা। প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে হার্ট অ্যাটাক। পরিবারের পক্ষ থেকে গোপনীয়তা বজায় রাখার আহবানে কিছুটা রহস্যও তাই থাকল। ২০০০ সালে উইজডেন শতাব্দি সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হিসেবে ঘোষণা করে। সেই ওয়ার্নের ক্যারিয়ারে আলো ফেললে পাওয়া যায় তোলপাড় করা সব ঘটনা।

বল অব দ্য সেঞ্চুরি

ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকেই তাক লাগানো এক ডেলিভারিতে সবার চোখ কপালে তুলে দেন ওয়ার্ন। ১৯৯৩ সালে মাইক গ্যাটিংকে বোল্ড করা বলটাকে বলা হয় শতাব্দির সেরা বল বা  'বল অব দা সেঞ্চুরি'। লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচড করে অদ্ভুত এক টার্নে যা কেড়ে নেয় গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্প।

২০০৫ সালে এজভাস্টনে অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে বোল্ড করেছিলেন আরেকটি মোহাবিষ্ট ডেলিভারিতে। বাঁহাতি স্ট্রাউস দেখছিলেন অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে পড়েছে বল। পা সামনে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই বল টার্ন করে কেড়ে নেয় স্ট্রাউসের লেগ স্টাম্প। ওয়ার্নের মোড় ঘোরনো দারুণ সব ডেলিভারি যেকোনো ক্রিকেট ভক্তের জন্য আনন্দদায়ী রসদ।

মাদকে নিষিদ্ধ, বিতর্ক, নারী আসক্তি

ক্যারিয়ারের কোন বাঁকে যেন খবরের আড়ালে পড়তে চাইতেন না ওয়ার্ন। কখনো কীর্তি দিয়ে, কখনো বিচিত্র কোন ঘটনার জন্ম দিয়ে। ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের ঠিক আগে মাদক পরীক্ষায় ধরে পড়ে নিষিদ্ধ হয়ে যান এক বছরের জন্য। এক বছর পর ফেরেন আরও শাণিত হয়ে। ২০০৫ সালে এক পঞ্জিকা বর্ষে নেন ৯৬ উইকেট। যা এক পঞ্জিকা বর্ষে নেওয়া কোন বোলারের সর্বোচ্চ। বিতর্ক তাকে ছেড়ে যায়নি। ২০০৮ সালে একটি কোম্পানির সঙ্গে ধূমপান না করার চুক্তি করেও ধূপমান করে ধরা পড়েন।

ওয়ার্নের নারী আসক্তি ছিল আরেক আলোচ্য বিষয়। এই কারণে তিন সন্তান নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যান স্ত্রী সিমোন ক্যালাহান। ওয়ার্ন চলেছেন তবু তার মতই। জীবনকে উপভোগ করেছেন নিজের তরিকায়। উদ্দাম জীবনযাপনকে করেছেন পাথেয়।  নারী আসক্তের আরেক উদাহরণ ২০০০ সালের। ব্রিটিশ এক নারীকে অশালীন বার্তা পাঠিয়ে হারিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়কত্ব। এই ঘটনার কারণে কখনো অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়া হয়নি তার। অনেকের মতে ওয়ার্ন অধিনায়কত্ব করলে হতে পারতেন সেরাদের সেরা এক অধিনায়ক। সতীর্থ স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, কোচ জন বুকাননের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েও আলোচনায় এসেছেন একাধিকবার। সোজা পথে নির্বিবাদী জীবন যেন তার সইত না।

তবু কীর্তিতেই ভাস্বর

বিতর্ক জীবনজুড়ে থাকলেও ওয়ার্নের কীর্তিই তাকে করে ভাস্বর। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল মাত করে জয়ের নায়ক, প্রথম বোলার হিসেবে ৭০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করা, মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অসংখ্য সব স্পেলই ওয়ার্নকে করে আলাদা। বাকি সব কিছু ছাপিয়ে কোন রকমের তর্ক ছাড়াই তিনি সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার।

আইপিএলেও মুন্সিয়ানা

ওয়ার্নের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার যখন শেষের পথে, তখন টি-টোয়েন্টি যুগের সূচনা। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তার খেলা হয়নি। তবে খেলেছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এ। ক্রিকেটের নতুন সংস্করণের ভাষা দ্রুত পড়ে মাত করেন তিনি। ২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম আসরে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল রাজস্থান রয়্যালসকে নেতৃত্ব দিয়ে শিরোপা জেতান ওয়ার্ন। বোলিংয়ের মতো ক্রিকেট মস্তিষ্কের দ্যুতি দেখান বিশ্বকে।

ধারাভাষ্য

ক্রিকেট ছাড়ার পর ধারাভাষ্যে যোগ দেন ওয়ার্ন। দারুণ সব বিশ্লেষণে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে থাকেন তিনি। খেলার ভেতরে গিয়ে টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে আলো ফেলে খুলে দেন নতুন চিন্তার দিক।

যত বিতর্ক, যত ঘটনা, খেলার মাঠের বাইরে গিয়ে যত কিছুই করুন না কেন। শেন কিথ ওয়ার্নকে চিরভাস্বর থাকবেন ভুবনজয়ী লেগ স্পিনার হিসেবে। ৫২ বছরের দপ করে নিভে যাওয়াটা হয়ে থাকল ধাঁধা হয়ে, তার ডেলিভারির মতো। নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয় তো! তবে এত আগে বলেই চলছে অবিশ্বাসের দোলাচল। 

Comments

The Daily Star  | English

Failure in state formation leads to the rise of fascist rule: Prof Ali Riaz

He made the remarks at the beginning of a discussion between the commission and the Amjanata Party.

56m ago