'গরীবের ঘরে আমার মেয়েগুলো সোনার মানিক'

'গরীবের ঘরে আমার মেয়েগুলো সোনার মানিক হয়ে জন্ম নিয়েছে।'
বলছিলেন আনাই মগিনির বাবা রিপ্রু মগ। কতটা আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর গর্ব মিশে আছে এই কথাগুলোতে তা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না। আনাইয়ের দৃষ্টিনন্দন গোলে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। তার জমজ বোন আনুচিং মগিনিও বিজয়ী দলের সদস্য।
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির গোলাবাড়ি ইউনিয়নের সাতভাইয়াপাড়া গ্রামে ২০০৩ সালে জন্ম নেন আনাই। আনুচিং তার দুই মিনিটের ছোট। পাহাড়ের কোলে নিত্য যেখানে মেঘ লুকোচুরি খেলে, সেখানে ছোট থেকেই তারা খেলতে শুরু করেন ফুটবল। গত বুধবার রাতে ওই গ্রামে ছিল উৎসবের আমেজ। তাদেরই আনাই যে ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে পরিণত হয়েছেন গোটা বাংলাদেশের মধ্যমণিতে!
অথচ আনাইয়ের যখন জন্ম হয়েছিল, তখন রিপ্রু ও আপ্রুমা মগিনি দম্পতির কপালে পড়েছিল চিন্তার ভাঁজ। টানাটানির সংসারে আরও দুটি নতুন মুখের খাবার যোগানো ছিল দুঃসাধ্য। রিপ্রু তুলে ধরলেন সেই কঠিন সময়ের স্মৃতি, 'যখন যমজ মেয়ের জন্ম হয়, সেই সময় তো আমাদের অভাব চলছিল। গরীব ছিলাম। ঠিকমতো খাওয়াতে পারতাম না। মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি পেত না। চালের গুঁড়া রান্না করে খাওয়ানো হতো ওদের।'

সময়ের চাকা ঘুরে মেয়েরাই সচ্ছলতা এনেছেন পরিবারে। শক্ত হাতে ধরেছেন সংসারের হাল। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাদের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সবুজ গালিচায় পায়ের কারুকাজ দেখিয়ে চলেছেন তারা। গত কয়েক বছর ধরে বয়সভিত্তিক দলের পাশাপাশি জাতীয় দলে পরিচিত মুখ আনাই ও আনুচিং।
২০১৮ সালে দেশের মাটিতে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। কিশোরীরা পরাস্ত করেছিলেন বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন ও ভিয়েতনামকে। গণভবনে ডেকে ওই দলকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রত্যেক সদস্যের হাতে ১০ লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন তিনি। আনাই ও আনুচিংয়ের পাওয়া ২০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে জমি।
অভাব-অনটন কেটে যাওয়ার কথা জানালেন আনাইয়ের বাবা, 'সবার আশীর্বাদে এখন আমরা ভালো আছি। ওই কষ্টের দিনগুলো পেছনে চলে গেছে। এখন আমরা সুখে আছি।'
মেয়েদের প্রতিনিয়ত উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছেন তিনি, 'আমি বলেছি, তোমরা ভালো করে খেলবে। ভালো করে অনুশীলন করবে। ভালোভাবে থাকবে। এগুলো শিখিয়ে দিয়েছি। বিশ্বকাপে যেন যেতে পারে, সেভাবে যেন খেলে, সেটা বলে দিয়েছি। আমি চাই, ওরা খেলুক। যত পারুক, খেলুক। মন দিয়ে খেলুক। (ওরা) যখন ছুটিতে এখানে আসবে, তখন ওদেরকে আরও ভালো খেলার জন্য আশীর্বাদ করব।'

ফাইনালে গ্যালারিভর্তি দর্শকদের সামনে দুর্দান্ত খেলেও গোলের দেখা পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। গোললাইন থেকে ভারত বল ফিরিয়ে দেয়। বাধা হয়ে দাঁড়ায় পোস্টও। যখন শঙ্কা জেঁকে বসার উপক্রম হয়েছিল, তখন ম্যাচের ৮০তম মিনিটে উদ্ধারকারী হয়ে আসেন আনাই। তার দূরপাল্লার শট প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে জড়ায় জালে।
টেলিভিশনে পুরো খেলা দেখেছেন রিপ্রু। আনাইয়ের গোল করার মুহূর্তের কথা তুলতেই, ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে হাসিমাখা গলায় বলে উঠলেন, 'খেলা খুব ভালোভাবে দেখেছি। আমার মেয়ে গোল দিয়েছে... কত আনন্দ যে লেগেছে, কত খুশি যে লেগেছে!'
আনাই ও আনুচিংয়ের মায়ের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের বাবা বললেন, 'ওদের মা সব সময় প্রার্থনা করে। বুদ্ধর (মূর্তির) সামনে ওদের জন্য সকাল-বিকাল বাতি জ্বালায়।'
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সময়ে আনাইয়ের অর্জনে গর্বিত খাগড়াছড়ির বাসিন্দারা। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে। অনেকে মনে করছেন, এই সাফল্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে অর্থবহ করেছে।

বিভাগীয় পর্যায়ে আনাই ও আনুচিংয়ের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বগাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা। তিনি পরে দুই বোনকে বগাপাড়ায় ভর্তির পাশাপাশি তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আনাইয়ের কৃতিত্বে দারুণ খুশি বীরসেন জানান, 'সেই সময় দুই বোনের বয়স কম হওয়ায় বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে পারতো না। তাই ওদের বাবাকেও এখানে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম।'
সাতভাইয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিহার রঞ্জন চাকমা বলেন, 'আমাদের ছাত্রী আনাইয়ের একমাত্র গোলে এবারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জয়লাভ করাতে আমরা খুবই খুশি হয়েছি। ওর বোন আনুচিংও দারুণ খেলে।'
সেখানে বসবাসরত এনজিও কর্মকর্তা কংসাজাই মারমার গর্ব হচ্ছে ভীষণ, 'আনাইয়ের কারণে সারাদেশের মানুষ আমাদের পাড়া সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। এতে আমরা খুব গর্ববোধ করছি।'
জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা জানান আনাইকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা, 'আনাই খাগড়াছড়ির কৃতি সন্তান। তার একমাত্র গোলে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের। সংস্থার আগামী সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা করা হবে এবং বাফুফের সাথে পরামর্শক্রমে তাকে সংবর্ধনা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
Comments