‘ফুটবলের গ্রাম’ পালিচড়া থেকে রোনালদোর পর্তুগালে

রংপুরের প্রত্যন্ত এলাকার ছোট্ট গ্রাম পালিচড়াকে নারী ফুটবলারদের গ্রাম বললে আসলে ভুল বলা হয় না। পুরো গ্রাম জুড়ে যে নারী ফুটবলারদের সরব উপস্থিতি। ২০১১ সাল থেকেই সেখানে নারী ফুটবলের দাপট। এই গ্রাম থেকে উঠে আসে বর্তমান জাতীয় দল ও বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলছেন নয় ফুটবলার।
দরিদ্র পীড়িত এই অঞ্চল থেকে এবার চারজন কিশোরী ফুটবলার জায়গা করে নিয়েছেন পর্তুগালে হতে যাওয়া মাসব্যাপী ফুটবল ক্যাম্পে।
পালিচড়ার চার কিশোরী ফুটবলার মৌরুসি আক্তার, রেখা আক্তার, নাসরিন আক্তার ও শাম্মি আক্তার প্রশিক্ষণ নেবেন পর্তুগালে গিয়ে।
এই কিশোরীদের ফুটবলারদের মৌলিক পাঠ দিয়ে যিনি রাখছেন অবদান সেই কোচ মিলন খানের চোখে এটা বিশেষ কিছু, 'তারা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেশে অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছে। এটা আমাদের জন্য দুর্দান্ত খবর।'
সম্প্রতি আট বিভাগের ৪০ জন খেলোয়াড় থেকে সেরা ১১ জন খেলোয়াড় বাছাই করেছে বিকেএসপি। এরমধ্যে চারজনই পালিচড়ার।

এই ক্যাম্পে সুযোগ পাওয়া মৌরুসি নিজেকে মনে করছেন ভাগ্যবতী, 'আমাদের জন্য এটা বিশাল সুযোগ। এক মাস পর্তুগালে অনুশীলন করব। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হিসেবে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করছি।'
আরেক কিশোর নাসরিন জানান, রোমাঞ্চে ভাসছেন তারা। এখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য ভাল খেলা।
এই কিশোরীদের এমন অর্জনের খবর চেয়ে গেছে পুরো এলাকায়। ফুটবল এবং বিশেষ করে মেয়েদের ফুটবল ঘিরে তাদের এলাকায় এমন কিছু হতে পারে সেখানকার মানুষের ভাবনাতেও ছিল না তা। এই কিশোরীদের উঠে আসার পথে ছিল পারিবারিক ও সামাজিক বাধা।
তবে সেসব দূরে ঠেলে আপাতত এলাকার নাম বিখ্যাত হওয়ার আনন্দে ভাসছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোহেল রানা, 'ফুটবলে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলাফল এটি। এরমধ্যে আমাদের গ্রামের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।'

আশার কথা হলো ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সাফল্যের প্রভাবে এই গ্রামে একটি ছোট ফুটবল স্টেডিয়ামও তৈরি করে দিয়েছে সরকার। অন্য জেলা থেকেও উদীয়মান ফুটবলরা এই গ্রামে এসে এখন নিজেদের মেলে ধরার চেষ্টা করছেন।
গত শনিবার পালিচড়া গেলে দেখা যায় কোচ মিলনের অধীনে ১২ জন কিশোরী ফুটবলার গ্রামের মাঠে বুট-জার্সি পরে অনুশীলন করছে। এই সংখ্যা সব সময় আরও অনেক বেশিই থাকে। রমজান মাস উপলক্ষে সংখ্যা কিছুটা কম বলে জানা যায়।
তবে এই পর্যায়ে আসাটা এত সহজ ছিল না। এমনকি এখনো তাদের সামলাতে হয় বিরূপ পরিস্থিতি। নারী ফুটবলারদের সাবেক কোচ হারুন উর রশিদ জানাচ্ছিলেন, মেয়েদের প্রতিনিয়ত টিটকিরি, বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয়। অনেক অভিবাবক তাদের মেয়েদের প্রতিদিন অনুশীলনে আসতে দিতে চান না।
মাঠে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আছে দারিদ্রের জন্যও। ভ্যান চালক এনামুল হক জানান, তার মেয়ে এনিমা আক্তারকে প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার দূর থেকে অনুশীলনে নিয়ে আসা আসলে সহজ হয় না। এতে খরচটা পড়ে অনেক। তবে মেয়ের জেদের কারণে তাকে সেটা করতে হচ্ছে, 'আমি যদি তাকে অনুশীলন ছাড়িয়ে দিতে চাই তাহলে সে হয়ত পায়ে হেঁটে চলে আসবে।'
অনেক মেয়েই বেশ দূর থেকে আসে অনুশীলনে। পর্তুগালে ক্যাম্পে সুযোগ পাওয়া নাসরিন জানায়, অন্তত একটা বাইসাইকেল হলে তাদের চলার পথ হতো সহজ, 'আমাদের তো কোন বাইসাইকেলও নেই, পরিবার আসলে তা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই।'
২০১১ সালে পালিচড়ার মেয়েদের ফুটবলের স্বপ্নযাত্রা শুরু। ফুটবল পাগল মেয়েরা তখন একটি দল তৈরি করে। সামাজিক পরিস্থিতি ছিল তখন ভীষণ প্রতিকূলে। মেয়েরা ফুটবল খেলবে, এটা মেনে নিতে পারছিল না অনেকেই। সব বাধার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নয়াপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ২০১১ সালে ১১ জন মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় খেলা। সেসময় মেয়েদের ফুটবলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা স্থানীয় জাকির হাসান জানান, কয়েক মাসের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ২১।
এরপর তারা অংশ নেয় বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেসা মুজিব গোল্ডকাপে। সেই টুর্নামেন্টে বিভাগীয় পর্যায়ে ও জাতীয় পর্যায়ে সেরা সাফল্য ধরে বদলে যেতে থাকে ছবি।
এই গ্রামের মেয়ের ২০১৫ সাল ও ২০১৬ সালে কেএফসি কাপে। ২০১৭ সালে জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৫ আসরেও চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। সেবার রংপুর জেলা হারিয়েছিল ময়মনসিংহকে। দলের নাম রংপুর থাকলেও পুরো দলটি আসলে সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামেরই।
Comments