উৎসব, দ্রোহ ও বিচ্ছেদের রঙ ছড়ানো বসন্ত

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

আজ ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। মাঘের শীতের তীব্রতায় যখন প্রকৃতিসহ মনুষ্যকুল ও জীবজগৎ কাবু, ঠিক তখনই আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের। ফাগুনের হাওয়ায় উৎসবের রঙে মেতে উঠে প্রকৃতি। শীতে  বৃক্ষের পত্ররাজি ঝরে পড়ে, প্রকৃতিতে আসে স্তব্ধতা। বসন্তের আগমনে সেই আড়মোড়া ভেঙ্গে প্রকৃতি হয়ে উঠে সজীব। বসন্তের আগমনধ্বনি পাওয়া যায় গাছের নতুন কুঁড়িতে। এক অনিন্দ্য সজীবতা, উচ্ছ্বাস আর আনন্দের পূর্ণরূপ শোভিত হয় বসন্তে। ষড়ঋতুর বাংলায় বসন্ত বাংলা বছরের সর্বশেষ ঋতু হলেও বসন্তকে ঘিরেই যাবতীয় উচ্ছ্বাস বাঙালির।

তাইতো সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত।/শান-বাঁধানো ফুটপাতে/পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ/কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে/হাসছে…'

কোনো কোনো গদ্যকার বসন্তকে আখ্যা দিয়েছেন বিচ্ছেদের, কোনো কবি বসন্তকে দেখেছেন কামের ঋতু হিসেবে, কোনো কবি বসন্তকে অভিহিত করেছেন আগ্রাসী ঋতু হিসেবে। কিন্তু সবখানেই বসন্ত বন্দনা। তা সে যে রূপেই হোক।

বাংলা ভাষায় কবিতায় বসন্তের আগমনী বার্তা প্রথম পাওয়া যায় মধ্যযুগের বাঙালি কবি আলাওলের কবিতায়। আলাওল কাব্যে  বসন্তকে দেখেছেন কামের ঋতু হিসেবে। ঋতু-বর্ণন কাব্যে তিনি লিখেছেন, 'মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।/মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥/কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।/পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল॥/ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।/শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব॥'

রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু বর্ষা হলেও বসন্তের আগমনধ্বনি পাওয়া যায় তার অজস্র গানে, কবিতায়। বসন্তের কবিতা বা গানে রবীন্দ্রনাথের  সৃষ্টিই সবচেয়ে বেশি।

রবীন্দ্রনাথের মোট ২ হাজার ২৩২টি গানের মধ্যে প্রকৃতি পর্বের গান আছে ২৮৩টি। এর মধ্যে বসন্ত পর্যায়ের গানের সংখ্যা ৯৮টি। বসন্তের চেয়ে কেবল বর্ষা পর্যায়ের গানের সংখ্যাই বেশি, ১২০টি।

প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ঋতু উৎসবের আয়োজন করতেন। তারও আগে কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবদার মেনে ১৩০৩ বঙ্গাব্দের বসন্তের পঞ্চম দিনে রবীন্দ্রনাথ সূচনা করেছিলেন 'ঋতুরঙ্গ উৎসব'। প্রথম ঋতুরঙ্গ উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,/আনন্দবসন্তসমাগমে॥/বিকশিত প্রীতিকুসুম হে/পুলকিত চিতকাননে॥/জীবনলতা অবনতা তব চরণে।/হরষগীত উচ্ছ্বসিত হে/কিরণমগন গগনে॥'

বসন্ত পঞ্চমীতে শমীন্দ্রনাথ ও আরও ২ জন ছাত্র বসন্ত সেজেছিল। ১জন সেজেছিল বর্ষা, আর ৩ জন সেজেছিল শরৎ। সে বছরের নভেম্বরে মাত্র ১১ বছর বয়সেই প্রয়াণ হয়েছিল শমীন্দ্রনাথের।

১৯২৫ সালে 'ঋতুরঙ্গ উৎসব' পরিবর্তিত হয় শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত 'বসন্ত উৎসব' নামে।

রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গানে লিখেছেন, 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে।/আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,/আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,/এই সংগীত-মুখরিত গগনে/তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।'

কাজী নজরুল ইসলামও কম যাননি বসন্ত বন্দনায়। লিখেছেন, 'বসন্ত এলো এলো এলো রে/পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহরে/মুহু মুহু কুহু কুহু তানে…'।

জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু হেমন্ত হলেও তার কবিতাতেও পাওয়া যায় বসন্তকে। 'পাখিরা' কবিতায় তিনি লিখেছেন, 'আজ এই বসন্তের রাতে/ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;/ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,/স্কাইলাইট মাথার উপর,/আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর…'।  

অবশ্য বসন্তকে ঋতুরাজ হিসেবে স্বীকার করার পক্ষে নন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বসন্তকে বলেছেন বিচ্ছেদের ঋতু।  'অনিমিষ একা' জার্নালে তিনি লিখেছেন 'বসন্তকে ঋতুরাজ বলার পক্ষে আমি নই। এ ঋতুতে প্রথম আমি প্রেমে প্রত্যাখাত হই। রাতের ময়দানে হাওয়া বইছিল, আকাশে তারা ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল গুটিবসন্ত ছেয়েছে আমাকে। ফিরে ফিরে বঙ্কিমের রোহিনীর মুখ ভেসেছিল। বসন্ত যেন হারানোর এক হাওয়া বইয়ে দেওয়া সময়।'

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও একই মত। বিখ্যাত উপন্যাস 'কৃষ্ণকান্তের উইল'-এ বঙ্কিম লিখেছিলেন, 'কোকিলের ডাক শুনিলে কতকগুলি বিশ্রী কথা মনে পড়ে। কী যেন হারাইয়াছি। যেন তাই হারাইয়া যাওয়াতে জীবনসর্বস্ব অসাড় হইয়া পড়িয়াছে। যেন তাহা আর পাইব না। যেন কী নাই। কেন যেন নাই। কী যেন হইল না। কী যেন পাইব না। কোথায় যেন রত হারাইয়াছি।'

আবার কবি নির্মলেন্দু গুণ বসন্তকে আগ্রাসী ঋতু হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি কবিতায় বলেছেন, বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারো। চোখ ফেরানো যাক তার লেখা কবিতা 'বসন্ত বন্দনা'য়। কবি এখানে বলছেন, 'এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,/যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।/বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি/নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে/গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।'

বসন্ত যে কেবলই কাব্য আর কবিতার তা কিন্তু নয়। বসন্তের মাঝে লুকিয়ে থাকে জাগরণের ধ্বনিও। বসন্ত কখনোবা হয়ে উঠে দ্রোহের প্রতিমূর্তি। বসন্তকে কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান দেখেছেন দ্রোহের প্রতিমূর্তি হিসেবে। তার ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা কালজয়ী উপন্যাস 'আরেক ফাল্গুন'- এ পাওয়া যায় নতুন করে জেগে উঠা, মাথা তুলে দাঁড়ানোর আখ্যান।

বসন্ত যেন বারবার বাঙালির জীবনে ফিরে আসে হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ের অনুষঙ্গ হয়ে। ৯ ফাগুন বাংলার ছাত্র যুবকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে অকাতরে বিলিয়েছে আপন প্রাণ। বসন্তের প্রথম দিনেই মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। পলাশরাঙা বসন্তের প্রথম দিনেই জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালিদের রক্ত মিশেছে রাজপথে।

তাই বাংলার বসন্ত কখনো উৎসবের, কখনো বিচ্ছেদের, কখনো বিষাদের, আবার কখনোবা সংগ্রামের। বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারো।

Comments

The Daily Star  | English

Sovereign guarantee rules to be revised

The government plans to amend the existing sovereign guarantee guidelines to streamline the process and mitigate fiscal risks if public entities fail to make repayments on time, according to a finance ministry report.

11h ago