পত্রিকার হকার থেকে জনপ্রতিনিধি
প্রতিদিন সকালে অনেকেই যখন বিছানায় ঘুমিয়ে থাকেন, তখন পাবনার চাটমোহর উপজেলার দুর্গম মল্লিকবাইন গ্রামের জান্নাতুল সরকার চম্পা বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেন সংবাদপত্র।
তার এ কাজকে সমাজের অনেকেই ভালো চোখে না দেখলেও, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া চম্পা বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প এমনই ছিল। থেমে যাননি তিনি, নতুন উদ্যমে পথ চলেছেন সবসময়। জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চম্পা এখন এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
মল্লিকবাইন গ্রামের ইসহাক আলি সরকারের ৬ সন্তানের মধ্যে ছোট চম্পা। সবার আদরে বেড়ে ওঠার কথা থাকলেও, স্কুলজীবন থেকেই তাকে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে।
চম্পা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে যাওয়ায় ছোটবেলা থেকেই অবহেলার মধ্যে দিয়েই তিনি বড় হতে থাকেন। ভাইরা আলাদা হয়ে যান স্কুলজীবনেই। মা-সহ সংসারের ভার আসে তার ওপর।
তখন পড়াশোনার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন চম্পা। ২০০৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগেই পরিবারের চাপে বাল্য বিয়ের শিকার হতে হয়। তবে মাত্র ১ বছরের মধ্যেই সে সংসার ভেঙে যায়।
নিজে উপার্জন করে এইচএসসি পাশ করার পর কাজ নেন চাটমোহর উপজেলার একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। কিছুদিন পরে তাকে অন্য জেলায় বদলি করা হলে, মাকে দেখাশোনার জন্য সে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
২০০৮ সালে কর্মহীন হয়ে একটি কাজের জন্য যখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন, তখন ফেরি করে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখে নিজেও সে কাজ শুরুর পরিকল্পনা করেন।
স্থানীয় একজন দোকানদারের সাহায্যে পত্রিকার এজেন্সির কাছ থেকে প্রথমে ৫টি পত্রিকা নিয়ে ফেরি শুরু করেন।
ডেইলি স্টারকে চম্পা বলেন, 'সে সময় অনেকেই নারী হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনতে আগ্রহী হতো না। অনেক মিনতি করে পত্রিকা বিক্রি করতাম। অনেকের কটু কথা শুনেছি।'
তবে দমে যাননি তিনি। কিছুদিনের মধ্যে কয়েকজন নিয়মিত গ্রাহক পেয়ে যান তিনি।
চম্পা বলেন, 'বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে কখনো পিছিয়ে যাইনি। একটি পত্রিকা বিক্রি করতে মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। এভাবে চলতে চলতে চাটমোহর উপজেলার প্রায় পুরো এলাকাতেই ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করেছি।'
বর্তমানে চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তার ২৭৫ জন নিয়মিত গ্রাহক আছেন।
কিছুদিন পর সাইকেল ছেড়ে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরতে হয় তাকে।
পত্রিকা বিক্রি করে চম্পা প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করেন। এ আয় দিয়ে মাকে নিয়ে ভালোভাবেই তার দিন কাটছে বলে জানান।
চম্পা বলেন, 'কাজকে ছোট মনে না করে পত্রিকা বিক্রিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। পত্রিকা বিক্রির কাজ দিনের প্রথম ভাগেই শেষ হয়ে যায়। তাই পুরো দিন অন্যান্য কাজ করারও সুযোগ পাই।'
এলাকায় পত্রিকা বিক্রি করে পরিচিতি পাওয়া এবং নিজের পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
চম্পা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আর এ অভিজ্ঞতা থেকেই এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার বাসনা তৈরি হয়। গত ২ বার ইউনিয়ন পরিষদে নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচন করেছি। প্রথমবার পরাজিত হলেও সম্প্রতি শেষ হওয়া নির্বাচনে এলাকার মানুষ আমাকে বিজয়ী করেছেন। এখন আমি তাদের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।'
তিনি জানান, সকালে পত্রিকা বিলি করে ইউনিয়ন পরিষদে এসে এলাকার মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেন।
জানতে চাইলে পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজাহার আলি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একজন পত্রিকার হকার হয়েও চম্পা ইউনিয়ন পরিষদের কাজ কখনো ফেলে রাখেন না। এলাকার মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সবসময় তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।'
এজন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও তাকে সবসময় সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান চেয়ারম্যান।
দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এবং বাল্য বিয়ের ১ বছরের মাথায় স্বামী চলে যাওয়ার পরেও ভেঙে না পরে চম্পার জীবন সংগ্রামে সফল হওয়ার গল্প এখন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
স্থানীয় কলেজ শিক্ষক মো. আনিসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা নিজেদের ব্যর্থতার জন্য তাদের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। কিন্তু চম্পার মত সংগ্রামী নারীরা কখনো ভাগ্যকে দোষ না দিয়ে, ঘরে বসে না থেকে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যান।'
চম্পা বলেন, 'আমাকে দেখে সমাজের অনেক নারীই এখন জীবন সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা আমাকে আরও সাহসী করে তুলেছে।'
Comments