চরাঞ্চলে স্কুলে না যাওয়া শিশুদের ‘ম্যালা কষ্ট’

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নে তিস্তা নদীর বুকে জেগে ওঠা চর দক্ষিণ ভোটমারীর বাসিন্দা তাজুল ইসলাম (৮) স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাজুলের বাবা আলমগীর হোসেন দিনমজুর। মা আনজুমান বেগম গৃহিনী।
স্কুলে ভর্তি হলেও তাজুলের ভাগ্য শহর কিংবা অন্য বিভিন্ন এলাকার সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের মতো প্রসন্ন না। তাদের ২টি গরু ও ৩টি ছাগল আছে। সপ্তাহের মাত্র ২দিন সে স্কুলে যায়। বাকি ৫দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে চরে ঘুরে গবাদিপশুর জন্য ঘাস সংগ্রহ করে।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথোপকথনে এসব কথা জানায় তাজুল। আক্ষেপভরা কণ্ঠে বলে, 'হামরাগুলা স্কুলোত না য্যায়া চরোত কাজকাম করি। হামরাগুলার ম্যালা কষ্ট হয়।'
তাজুলের মতো এই এলাকার চরাঞ্চলে বাস করা শিশুদের গল্পগুলোও মোটামুটি একই রকম। তাজুল বলে, 'মোর বাপ মাও কাজ করির কয় সেইজইন্যে মুই চরো কাম করোং। মোর মতোন সোকগুলা চ্যাংরায় চরোত কাম করি খায়।'
গল্পে গল্পে জানা যায়, সপ্তাহের যে দুটো দিন তাজুলের স্কুলে যাওয়ার জন্য বরাদ্দ, সেই দিনগুলোতেও স্কুলে যাওয়া-আসার পথে তাকে ঘাস সংগ্রহের কাজ করতে হয়। তবে এই জীবনযাপনের সঙ্গে সে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে।
তাজুল বলে, 'চরোত কাজ করা হামার অভ্যাস হয়া গ্যাইছে। ডাইল আলু ভর্তা আর শাকটাক দিয়া ভাত খাওয়া হয়। হামরা সবাই একেই খাবার খাই। গোশত কম খাই। মাঝে মাঝে আব্বা নদীত মাছ ধরলে অ্যাকনা মাছ দিয়া ভাত খাই।'
চরাঞ্চলে বাস করা সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুর চাওয়া-পাওয়ার পরিধিও কম। তার একটিমাত্র জামা। আরেকটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তেমন নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাজুল বলে, 'হামরা চরোত ঘুরি বেড়াই। হামারগুলার নয়া জামা কিসোত নাগে? অ্যাকনা পিরান আছে তাকে গাত দিয়া স্কুল যাং।'

কথা হয় তাজুলের বাবা আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। দিনমজুরি করে পেট চালানো এই ব্যক্তির দর্শন হলো, 'হামারগুলার ছওয়ার নেখাপড়ার চাইতে কাজ করি খাওয়া অনেক ভাল। নেখাপড়া করি কি হইবে? হামারগুলার ছওয়ার তো আর চাকরি-টাকরি হবার নয়।'
তাই ছেলেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। বলেন, 'ছওয়াটাক কিলাস ফাইভ পযর্ন্ত পড়াইম। মোর সাথে কাজ করা শিখবার নাইকছোং। হামরা গরু ছাগল পুষি। ভালো টাকা পাই।'
একই এলাকার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া আরেক শিক্ষার্থী মোকসদুল ইসলামের অবস্থাও তাজুলের মতো। তারও ভাষ্য, 'হামার ভালো অ্যাকনা পিরান নাই, ভালো অ্যাকনা খাবার পাং না। তাতে হামার কষ্ট হয় না। হামার বড় ভাই ও বোনেরা এরকম করি মানুষ হইছে।'
নিজের ভাগ্যকে মেনে নেওয়া মোকসেদুল বলতে থাকে, 'সকাল বেলা পানতা ভাত খায়া চরোত আসি আর বিকাল বেলা বাড়িত যাই। দুপুর বেলার খাবার হামার জোটে না। মাঝে মাঝে বাড়িত গ্যাইলে খাই।'
সপ্তাহে ২-৩ দিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া মোকসেদুল আরও বলে, 'স্কুলোত য্যায়া অ্যাকনা পইড়বার পাই। বাড়িত তো অ্যাকনাও পড়া হয় না।'
এ ব্যাপারে মোকসেদুলের বাবা মোকতার হোসেনের ভাবনাও তাজুলের বাবার মতো। তিনি বলেন, 'হামার চরোত ছওয়া পোয়া কিলাস ফাইভ পযর্ন্ত নেখাপড়া শিখে থাকে। তাদেরকে হাদিস কোরান শিখাই। কোন কোন ছওয়া মেটটিক পাস করে। যেইগলা ছওয়া মেটটিক পাস করে তাকগুলাক নিয়া পরে ঝামেলার পড়তে হয় পরিবারের লোকজনের।'
চরের জীবিকায়ন নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধি সোহেল রানার পর্যবেক্ষণ হলো, 'চরাঞ্চলে এখনো অনেক কুসংস্কার আছে। তবে আগের তুলনায় চরের বাসিন্দাদের মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিছুসংখ্যক মানুষ এখনো তাদের ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাতে আগ্রহী না হলেও অনেক পরিবারের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।'
এ বিষয়ে কথা হয় লালমনিরহাটের জেলা প্রথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিও) গোলাম নবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করে তোলার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। শিক্ষকরা এ ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চরের অভিভাবকরা এখনো অসচেতন। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম।'
Comments