শিক্ষাখাত পুনরুদ্ধারে দরকার ৯ কোটি ডলার

একটি সমীক্ষার ভিত্তিতে সরকার প্রাথমিকভাবে অনুমান করেছে, করোনাভাইরাস মহামারিতে চরম ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষা খাতের পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অন্তত ৯ কোটি ডলার বাড়তি প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৭৬৮ কোটি টাকারও বেশি (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা বিবেচনায়)।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ থেকে এই অর্থ আলাদা।
'পজিশন পেপার অন কোভিড-১৯: ইমপ্লিকেশান্স অন এডুকেশন অ্যান্ড গ্র্যাজুয়েশন ট্র্যাজেক্টরি ফর বাংলাদেশ' নামের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাড়তি ৯ কোটি ডলারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। সমীক্ষাটি যৌথভাবে করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রোজেক্ট ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।
এই সমীক্ষাটি এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে এর একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার এবং গ্রস সেকেন্ডারি এনরোলমেন্ট অনুপাতটি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চেষ্টায় থাকা অন্য কিছু দেশের চেয়ে বেশি।
তবে মহামারির কারণে এই প্রগতি কিছুটা থমকে আছে এবং এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে গ্রস সেকেন্ডারি এনরোলমেন্টের ওপর এবং সেকেন্ডারি পর্যায়ে লিঙ্গ সমতার ওপর।
পজিশন পেপারটি বিভিন্ন কাগজপত্র ও প্রতিবেদনের নিরীক্ষণ ও দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন অংশীজন এটা যাচাই করেছেন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বস্তুত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাস সংকটের প্রেক্ষাপটে প্রতিক্রিয়া ও পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাটি তৈরি করেছে, যার জন্য আনুমানিক ৯০ মিলিয়ন ডলার (৭৬৮ কোটি টাকা) বাজেট প্রয়োজন। এই পরিকল্পনাটি প্রথমে করোনাভাইরাসের জন্য গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই) এক্সেলারেটর তহবিলের সহায়তায় এগিয়ে যাবে। পরবর্তীতে অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা এর সঙ্গে যুক্ত হবে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা বাজেট সম্পর্কে একটি প্রাথমিক অনুমান তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, 'পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার অর্থায়ন বড় আকারের সমস্যা হবে না। উন্নয়ন অংশীদারদের অর্থায়নে এর বাস্তবায়ন দ্রুত এগিয়ে যাবে, কিন্তু সেটি না হলেও তহবিলের অভাবে বাস্তবায়ন থেমে থাকবে না।'
সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে একজন সিনিয়র শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা জানান, প্রায় ২০ দশমিক সাত মিলিয়ন ডলার খরচ হবে টিভি, রেডিও, মোবাইল ও অনলাইন কন্টেন্ট এবং স্বল্প খরচের শিক্ষা প্যাকেজ তৈরি ও বিতরণের জন্য। স্বাস্থ্য বিধি মেনে স্কুলগুলো আবারও খোলার উদ্দেশ্যে স্যানিটাইজ করা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে সচেতনতা বাড়ানো, শিশু ও শিক্ষকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য আরও ৩৬ দশমিক ছয় মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, স্কুলে ফেরার পর শিক্ষার্থীদের যাচাই ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রায় ১০ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। সম্পূর্ণ শিক্ষা উপকরণ ও সম্প্রদায় ভিত্তিক কার্যক্রমের জন্য আরও চার মিলিয়ন ডলার লাগবে।
বাকি অর্থ প্রয়োজন হবে যোগাযোগ, প্রযুক্তি, সাধারণ শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিকে সংযুক্ত করা, দূরশিক্ষণ প্ল্যাটফর্মগুলোর উন্নয়ন ও নীতিমালা নির্ধারণের জন্য।
সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে, যার মধ্যে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে এবং নয় হাজার ১৫৪ কোটি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের জন্য। এটি বাজেটের ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকার বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর দিকে নজর রেখেছে। তবে এখনও সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
মহামারির কারণে সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং তা বিভিন্ন পর্যায়ে। নতুন বেশ কিছু দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং আগের দুর্বলতাগুলো আরও তীব্র হয়েছে।
মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে এবং এতে প্রায় ৩ কোটি ৬৮ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
শিক্ষার ওপর অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাস দেশের দারিদ্র্যকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২০ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে গেছে।
'বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে মানুষ তাদের মৌলিক খাদ্য চাহিদা মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে। সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) জানিয়েছে, মহামারীর আগে আনুমানিক ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীদের পরিবার দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছিলেন, যেটি তিন মাস দীর্ঘ লকডাউনের পরে বেড়ে ৪৪ শতাংশ হতে পারে', সমীক্ষায় প্রকাশ।
পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু না করা হলে দেশের শিশু বিবাহ পরিস্থিতির ওপরেও প্রভাব পড়বে। ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশু বিবাহের হার সবচেয়ে বেশি।
সুপারিশ
পজিশন পেপারটি সুপারিশ করেছে, দুই থেকে তিন বছর ব্যাপী 'ব্যাক টু স্কুল' প্রচারণা চালু করতে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরে না আসার প্রবণতা বেশি হতে পারে। স্কুলে ফিরে আসার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগটি বেশ কার্যকর হতে পারে। এ ধরণের উদ্যোগগুলোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে, যেমন ভাতা দেওয়া অথবা স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা করা।
শিক্ষার গুরুত্ব, শিশু বিবাহ ও শিশু শ্রমের প্রভাব, ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর সুপারিশও করা হয়েছে সমীক্ষায়। স্কুল ফিডিং কর্মসূচিকে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে, যাতে মহামারির সময়ে পড়ালেখা বন্ধ থাকার কারণে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়।
করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লিঙ্গ সমতা বজায় রাখার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সমীক্ষায়।
সমীক্ষায় প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির সন্নিবেশ ঘটানোর সুপারিশ করা হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে আসতে চাইবে না, তাদের জন্য অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছে।
জিডিপির চার শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে শিক্ষা খাতের দুর্বলতাগুলোর সমাধান করার সুপারিশ করা হয়েছে সমীক্ষাটিতে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানান, সরকারের শিশু বিবাহ ও বাচ্চাদের স্কুলে ফিরে না আসার সমস্যাগুলোর সমাধান করার পরিকল্পনা আছে।
তিনি বলেন, 'স্কুলগুলো আবারও খুলে গেলে ব্যাপারটি সহজ হবে। এখন অনেকেই পূর্বাভাষ দিচ্ছেন অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুলে ফিরবে না, কিন্তু আমরা দেখেছি মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অংশ হিসেবে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টগুলোর ক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সেগুলো শেষ করে নিজ নিজ স্কুলে জমা দিচ্ছে।'
তিনি জানান, 'আমরা সুপারিশগুলো নিরীক্ষণ করে তারপর সেগুলোর বাস্তবায়নের দিকে নজর দেব।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments