যেভাবে শনাক্ত হলো গাইবান্ধায় আতঙ্ক ছড়ানো প্রাণীটি
গাইবান্ধায় আতঙ্ক ছড়ানো প্রাণীটিকে আজ বুধবার খেঁকশিয়াল হিসেবে শনাক্ত করেছে বনবিভাগের ২টি দল। এ কাজে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের পরিবেশবাদী সংগঠন 'তীর'।
রাজশাহী থেকে আসা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণের একটি দল এবং ঢাকা থেকে বন বিভাগের পাঠানো ৩ সদস্যের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ দল।
ভাইরাসে আক্রান্ত শিয়ালটির কামড়ে গত মাসে উত্তর হরিনাথপুর গ্রামের এক মসজিদের ইমাম চিকিৎসাধীন অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এর পরে পলাশবাড়ী উপজেলার ৫ গ্রামের মানুষকে আক্রমণ করে এই পাগলা শিয়াল। এর মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছেন।
এরপর চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণীটির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর, তালুক কেওড়াবাড়ি, কিশামত কেওড়াবাড়ি, খামার বালুয়া গ্রামের মানুষ নানাভাবে সাহায্য প্রার্থনা করেন।
গতকাল মঙ্গলবার বন বিভাগের প্রধান বনসংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী এই বিশেষজ্ঞ দলটিকে ঘটনাস্থলে পাঠান বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা রাহাত হোসেন।
ঢাকা থেকে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন মো. কামরুদ্দীন রাশেদ, মাহবুব-ই-খোদা জুয়েল ও গাজী সাইফুল তারিক।
আজ বুধবার সকালে ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই ২ দলের সদস্যরা।
প্রাণীটির শনাক্তকরণ সম্পর্কে কামরুদ্দীন রাশেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এখানে গতকাল থেকে সরেজমিনে কাজ করেছি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলেছি। মৃত ইমামের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। সে সঙ্গে অনেকটা জায়গা জুড়ে নানা প্রাণীর পায়ের ছাপ সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখতে পেয়েছি যে আক্রান্ত এলাকায় ছোট শিয়াল ও খেঁকশিয়ালের আধিক্য বেশি।'
'গত রাতে মাঠের মধ্যে অনেকটা জায়গা পর্যবেক্ষণ করেছি। এ ছাড়া, আক্রান্তের ধরন, সময়, আক্রমণকারী প্রাণীটির আকার-আকৃতি, কামড়ের বা আঁচড়ের দাগের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছি। এরপর বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণের একটি দল যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হয়েছি যে এটা আসলে ছোট শিয়াল বা খেঁকশিয়াল।'
'আমরা এই এলাকায় প্রচুর সংখ্যক শিয়ালের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। তবে সব শিয়াল, কুকুর বা অন্য পশু কিন্তু জলাতঙ্ক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। বেশিরভাগ শিয়ালকে আমরা স্বাভাবিক থাকতে দেখেছি। তবে খুব স্বল্প সংখ্যক শিয়াল আক্রান্ত হওয়ার জন্য এই ঘটনাটা ঘটছে।'
'এলাকায় যেমন গুজব ছড়িয়েছে সে রকম কোনো ওয়াইল্ড ক্যাট বা ওয়াইল্ড ডগের উপস্থিতি আমরা দেখিনি,' যোগ করেন তিনি।
ইমামের মৃত্যু কারণ সম্পর্কে কামরুদ্দীন রাশেদ বলেন, 'ওনার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ও ওনার চিকিৎসার বিস্তারিত শুনে মনে হয়েছে আক্রান্ত ইমাম ফেরদৌস সরকার রুকুর চিকিৎসা অনেক বিলম্বে হয়েছে বা চিকিৎসায় কিছু ভুল হয়েছে।'
বিশেষজ্ঞ দলটির অপর সদস্য মাহবুব-এ-খোদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মিডিয়াতে যেভাবে সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে তাতে অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি যে অদ্ভুত প্রাণীটি কুকুরকেও আক্রমণ করেছে। সে কারণে আমাদের আগ্রহ আরও বেশি ছিল। এখানে এসে দেখলাম কয়েকটি কুকুরের গায়ে ঘা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছে যে ঐ প্রাণীর আক্রমণে এমন হয়েছে। আসলে এই সময় কুকুরের গায়ে ঘা হয়ে থাকে। কুকুরকে সাধারণত লেপার্ড বা চিতা জাতীয় প্রাণী আক্রমণ করে থাকে যা এখানে নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'তাছাড়া, এটি শিয়ালের প্রজনন সময়। প্রজননকালে অনেক পশু-পাখির গায়ের রঙ কিছুটা পরিবর্তিত হয়। শিয়ালের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। স্থানীয়দের আগের শিয়াল দেখা এখনকার শিয়ালের সঙ্গে মিলছে না। লোকজন এটাকে অদ্ভুত, অচেনা প্রাণী হিসেবে ধারণা লাভ করেছে। আসলে এটা গুজব।'
'আক্রমণকারী প্রাণীটি খেঁকশিয়াল,' উল্লেখ করে মাহবুব-এ-খোদা আরও বলেন, 'আজকে আতঙ্কিত মানুষের মধ্যে আমরা কাউন্সিলিং করবো যাতে তাদের ভ্রান্ত ধারণা দূর হয় এবং স্বাভাবিক ও সচেতনভাবে তারা চলাফেরা করতে পারেন।'
কিভাবে এই পাগলা শিয়ালের আক্রমণ থেকে লোকজন তাদের রক্ষা করতে পারে জানতে চাইলে কামরুদ্দীন রাশেদ বলেন, 'লোকজনকে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হবে। সেই সঙ্গে এলাকার লোকজনের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে তারা আতঙ্কিত হয়ে সব প্রাণীকে মেরে না ফেলেন। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমকে আরও বেশি সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে না পরে। গণমাধ্যম এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।'
যারা আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন তাদের সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে বলেও মনে করেন এই বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ।
Comments