নিউইয়র্কের জীবন

ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, লন্ডন-আমেরিকা থেকে কেউ দেশে ফিরলে বাড়ির ঘর, উঠান, বাথরুম পরিষ্কার করার হিড়িক পড়তো। নিজের সন্তানের জন্য এমন আয়োজন হতো, যেন বাড়িতে বড় কোনো তারকা আসছে।
নজরুলের মতো জগৎটাকে যেন আমরা আজ হাতের মুঠোয় দেখছি। সেলিব্রেটি হই আর না হই, মুখোশের আড়ালে আমরা সবাই সেলিব্রেটি।
সত্য বলতে, বিদেশে ভোর থেকে সন্ধ্যা বা রাত পর্যন্ত আমরা কখনো ক্লিনার, ঝাড়ুদার, কখনো রাঁধুনি, কখনো ধোপা, কখনো ড্রাইভার, কখনো কুলি। বাহিরে কর্মকর্তা হই আর কর্মচারী, ঘরে এসে সব কাজ নিজ হাতেই করতে হয়। দেশে থাকতে যার কাজ করে দেওয়ার জন্য ৩ জন মানুষ থাকতো, তারও অবস্থা প্রায় একই।
এখন আর শুধু আত্মীয়-স্বজন না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবাই ভাবেন, যারা উন্নত বিশ্বে থাকেন তারা যেন 'বিশেষ কিছু'।
আপনারা হয়তো ভাবেন, এটাই হয়তো নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলস বা এমন বড় শহরে থাকার আনন্দ, সাফল্য। সেখানে শুধু মজা আর মজা!

বিদেশে নানান ভাবে বাংলাদেশের মানুষ দেশকে তুলে ধরে। কেউ পজিটিভ বাংলাদেশকে তুলে ধরে, আবার কেউবা স্বার্থের খাতিরে বাংলাদেশকে তুলে ভিখিরির বেশে। যদিও যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকেন।
কিছুদিন আগেই আমার সহকর্মী মালিকা পেগাসাস বলছিলেন, কোরিয়ানরা রাস্তায় টয়লেট করে এবং এটাই নাকি এশিয়ার সংস্কৃতি। সত্যতা যাচাই করার জন্যই তিনি আমাকে এসব বলছিলেন। যে ডকুমেন্টারি তিনি দেখেছেন সেটাও দেখালেন।
তখন তাকে আমি বললাম, আমেরিকাতেও যেমন গৃহহীন মানুষ আছে, নিরক্ষর জনগোষ্ঠী আছে, তেমনি এশিয়াতেও আছে। আমাদের দেশেও বস্তি আছে, যেখানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো না। এর অর্থ এই নয় যে দেশের সংস্কৃতিই এমন।
মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো, কারা এভাবে দেশকে উপস্থাপন করছে?
এ দেশে বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশের জীবন কাজ, খাওয়া, ঘুম আর আপনজনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা ছলাকলা করতে পারেন না। করতে গেলেও ধরা খেয়ে যান। তাদের কথা খুব কম পাবেন এই শহরের বক্তৃতায়, পত্রিকায়। তাদের কথা সাধারণত কেউ বলেন না।

এই পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীর অনেকের কাগজপত্রের ঘাটতি আছে। কেউ এসেছেন পড়াশোনা করতে, কেউবা কাজের জন্যই। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তাদের দক্ষতার সীমাবদ্ধতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করা হয়ে ওঠে না। ঘুরেফিরে তাদের কর্মসংস্থান হয় বাঙালি মালিকদের প্রতিষ্ঠানেই। অনেক সময় সেখানেও তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া হয়।
যেখানে নিউইয়র্কে সর্বনিম্ন কর্ম ঘণ্টা ১৫ ডলার, সেখানে তারা হয়তো পান ৫ ডলার থেকে বড় জোর ৭ ডলার। কখনো তারচেয়েও কম। দেশে যে শিশুটি অতি যত্নে লালিত হয়েছে সে বড় হয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় এ দেশে এসে কোনো রকমে জীবনযাপন করছে। যার অবস্থা ঘরের কাজের মানুষটির মতো। এই জীবনযাপনের কথা না পারে বলতে, না পারে সইতে। তারপরও চোখে স্বপ্ন আর মুখে হাসি নিয়ে ভিডিও কলে মাকে বলে, 'ভালো আছি মা।'
সেলিনা আক্তার, এনওয়াইসি ক্রাইসিস কাউন্সিলর, নিউ হরাইজন কাউন্সিলিং সেন্টার, নিউইয়র্ক
Comments