বসতি অস্ট্রেলিয়ায়, হৃদয়ে বাংলাদেশ

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সিরিজ বিজয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ের মানুষ আনন্দে দুলে উঠেছেন প্রবল ঢেউয়ের মতো।

ঠিক তেমনই অস্ট্রেলিয়ার প্রশান্ত পাড়ের বাংলাদেশিরাও ভাসছেন উল্লাসের জোয়ারে।

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। বহুজাতিক এই ভূখণ্ডে আক্ষরিক অর্থে কেউ প্রবাসী নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা মানবিক পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং বিশ্ব জুড়ে সামাজিক বিপন্নতা আর  রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন নীতিকে করেছে নমনীয়, করেছে উদার।

১৯০টিরও বেশি দেশ এবং ভিন্ন জাতি মানুষ এখানে গড়ে তুলেছে একটি শ্রেণীহীন রাষ্ট্র, বৈষম্যহীন সমাজ। সব জাতি মিলে তৈরি করেছে একটি মানবিক জাতি। রাষ্ট্র হিসেবে অস্ট্রেলিয়া এতোটাই মনুষ্যত্বপূর্ণ যে একজন মানুষও এখানে নিজেকে পরবাসী ভাবার সুযোগ পায় না।

অভিবাসী হিসেবে প্রশান্ত পাড়ে বাংলাদেশিদের আগমন খুব বেশি দিনের না হলেও এরই ভেতর তারা এখানকার মাটিতে খুব শক্ত করেই পুঁতে ফেলেছেন নিজেদের শেকড়। অস্ট্রেলিয়া তাদের উন্নত জীবন দিয়েছে, বিত্তশালী করেছে, বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে, দেশে প্রিয়জনদের সাহায্য করার সুযোগ দিয়েছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিয়েছে নিশ্চিত সুন্দর জীবন। তারপরও বাংলাদেশিরা সারাক্ষণ হৃদয়ে ধারণ করে রাখেন প্রিয় বাংলাদেশকে। প্রিয় জন্মভূমির ভালো সংবাদে যেমন তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন, তেমনই খারাপ সংবাদে হন বেদনাহত।

(উপরের সারিতে বা থেকে) রতন কুণ্ডু, শাহে জামান টিটু, আব্দুল খান রতন, (মাঝের সারিতে বা থেকে) তিশা তানিয়া, তাম্মি পারভেজ, মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, (নিচের সারিতে বা থেকে) ফজলুল হক শফিক, পূরবী পারমিতা বোস এবং আরিফ রানা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে সাড়ে সাত হাজার মাইল দূরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বসেই বাংলাদেশের কাছে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয়ে আনন্দ আর উল্লাসে ভাসছেন প্রতিটি বাংলাদেশি।

ক্রিকেটের সবগুলো সংস্করণের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয় করলো বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বিভিন্ন পেশার বাংলাদেশিরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে।

কলাম লেখক ও সংগঠক রতন কুণ্ডু বলেন, 'কী পাইনি? অস্ট্রেলিয়া আমাকে কী দেয়নি? নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি, বিত্ত, বৈভব, দুশ্চিন্তাহীন জীবন দিয়ে আমার ইচ্ছে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে। অথচ ক্রিকেটে যখন আমার পালনভূমি অস্ট্রেলিয়া আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হলো, আমি আনন্দ উল্লাসে আপ্লুত হলাম। আমি কি চরম অকৃতজ্ঞ? আমি কি চরম স্বার্থপর? এখানে আবেগের কাছে যুক্তি বারবার পরাজিত হয়। আর তাতেই আমার সুখ! তাতেই আমার উল্লাস!'

শাহে জামান টিটু অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতাসীন দল লিবারেল পার্টির ব্যাংক্সটাউন ক্যান্টারবুরি সিটি কাউন্সিল অঞ্চলের সভাপতি। তিনি তার আবেগ প্রকাশ করে বললেন, 'আমি কি করে ভুলবো আমার শেকড়ের টান, নাড়ির টান! আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারবো না আমার ছেলেবেলার বাংলাদেশের স্মৃতি। এখনও আমি বুকে ধারণ করে আছি প্রিয় বাংলাদেশ।'

অস্ট্রেলিয়ার সর্বজনীন সংগঠন বিডি হাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খান রতন তার মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-২০ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়ে আমি বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে গর্ববোধ করি। আবার অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় আমাকে ব্যথিত করে। এটি বোধ হয় একদিকে নাড়ির টান, অন্যদিকে জীবনযাপনের বর্তমান ঠিকানা।'

ফাগুন হাওয়ার সভাপতি তিশা তানিয়া বলেন, 'আমার জীবনের আজকের সুন্দর, সাফল্য নিশ্চিত করতে এই দেশের ভূমিকাও অপরিসীম। এবারের টি-২০ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে অনেক অনেক অভিনন্দন বাংলাদেশ টাইগার টিমকে। পাশাপাশি খারাপ লাগছে অস্ট্রেলিয়ার জন্যও। কারণ অস্ট্রেলিয়ার সুনাগরিক হিসেবে এ দেশের প্রতিও আমার অনুভূতির জায়গাটাও সমান।'

বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া ফ্যাশন ডিজাইন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাম্মি পারভেজ বললেন, 'আমি অস্ট্রেলিয়ায় আছি প্রায় ১৮ বছর। এখানে উচ্চশিক্ষা, চাকরি, চিকিৎসা এবং উন্নত জীবনযাত্রার সবকিছু পেয়েছি। তাই অস্ট্রেলিয়ার প্রতি অবশ্যই আমার ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু সেই ভালোবাসা আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়, গর্বে বুক ভরে ওঠে। তাই সবকিছুর ওপরে আমার প্রিয় দেশ, আমার সোনার বাংলাদেশ।'

অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, 'পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমরা থাকি না কেন, আমরা হৃদয়ে জন্মভূমি বাংলাদেশকে ধারণ করি। আর ক্রিকেট আমাদের গৌরবের। কোনো বিদেশি যদি আমাদের জিজ্ঞেস করে, তুমি আসলে কোন দেশের? তখন উত্তরে বাংলাদেশ বললে তারা বলে ওঠে, ওহ ক্রিকেট? বাংলাদেশকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না।'

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়ার সাবেক সভাপতি ফজলুল হক শফিক বলেন, 'এটা সত্যি যে, অস্ট্রেলিয়া আমাকে সামাজিক নিরাপত্তাসহ অনেক কিছুই দিচ্ছে। কিন্তু নিজের মাকে অস্বীকার করি কিভাবে? অস্ট্রেলিয়ান সরকারও আমাকে সেই স্বাধীনতার প্রতি সন্মান দিচ্ছে।'

সাংস্কৃতিক সংগঠন 'আমাদের কথা'র প্রধান পূরবী পারমিতা বোস বলেন, 'মাতৃভূমির যেকোনো সাফল্যই মানুষকে আনন্দ দেয়। তার ওপর বাংলাদেশের মানুষ অতি সংবেদনশীল। তাই তাদের দেশের প্রতি আবেগও বেশি। আর প্রবাস জীবন হয়তো আমাদের সুখ সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু দেশকে আরও বেশি করে ভালোবাসতেও শিখিয়েছে। প্রবাসে আছি বলেই হয়তো এই অনুভূতি আমাদের আরও বেশি।'

আরিফ রানা বাংলাদেশি কমিউনিটির সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠক। তিনি বলেন, 'মাতৃভূমির প্রতি যে ভালোবাসা ও মমত্ববোধ দেশের সীমানা পেরিয়ে আসলে তার অনুভূতি অনেক গুণ বেড়ে যায়।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার মনে হয় প্রতিটা প্রবাসীর মধ্যেই দেশের জন্য একটা অজানা বেদনাবোধ কাজ করে প্রতিনিয়ত। সে কারণেই আমরা যারা অস্ট্রেলিয়ায় থাকি, বাংলাদেশ যখন হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে, তখন আবেগে আর আনন্দে চোখ ভাসাই।'

আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Polls no later than June 2026

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said that next national polls will be held within June 2026.

3h ago