একটি স্বপ্ন ও সেই পথে এগিয়ে চলা

ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দীর্ঘ দিনের যে লালিত স্বপ্ন ছিলো তা ২০০০ সালের জুন মাসে লন্ডনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের বার্ষিক সম্মেলনে বাস্তব রূপ পায়। এটা ছিলো সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পাওয়ার মত যা নিয়ে তখন অনেকের মনেই সন্দেহ ছিলো।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়টাতে বিসিসিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুপ্ত সম্ভাবনা আমাকে ক্রমেই আশাবাদী করে তোলে। টেস্ট স্ট্যাটাসের আবেদনের জন্য তখন খুব অল্প মানুষ আগ্রহ দেখালেও এ ব্যাপারে আমার বিশ্বাসে এতটুকু ঘাটতি ছিলো না।
১৯৯৬ সালের শেষভাগে তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট কনট্রোল বোর্ডের নতুন সভাপতি হিসেবে বোর্ডের সদ্যগঠিত নির্বাহী কমিটির বৈঠকে আমিই প্রশ্নটি তুলি—আমাদের ক্রিকেটের জন্য কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবো আমরা?
সেই কমিটিতে অভিজ্ঞ সৈয়দ আশরাফুল হক ও ক্রিকেট থেকে উঠে আসা প্রত্যেক সদস্যকে পাওয়া সত্যিই আমার জন্য সৌভাগ্য ছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নতুন বোর্ডের জন্য পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তখন।
সেখান থেকেই আমাদের স্বপ্নের শুরু। আমাদের সামনে তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করতাম লক্ষ্য অর্জনে দরকার যথাযথ পরিকল্পনা আর পরিকল্পনা সাজাতে ব্যর্থ হওয়ার একটাই অর্থ ছিলো আমার কাছে, তা হলো ব্যর্থ হওয়ার পরিকল্পনা।
আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতার নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এর পর ১৯৯৬ সালে এসিসি ট্রফি জয়, মালয়েশিয়ায় ১৯৯৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে আইসিসি ট্রফি জয় ও ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বকাপে (সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় ছাড়াও আরও একটি ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ) খেলা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বিশ্বব্যাপী নতুন পরিচিতি এনে দেয়। সেই সাথে সফলভাবে মিনি বিশ্বকাপ ও ইন্ডিপেন্ডেন্স ট্রফি আয়োজন ঢাকাকে ক্রিকেট বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে সামনে নিয়ে আসে। এসবের মাধ্যমে ক্রিকেট বিশ্বকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করানো, ক্রিকেটের প্রতি দেশের জনগণের আবেগ-ভালোবাসার সাথে গণমাধ্যম ও স্পন্সরদের আগ্রহ আমাদের পরিকল্পনা মতো চলতে থাকে।

দক্ষিণ এশিয়ার বন্ধুদের সমর্থন (ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা) আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলে। এর পর ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মত আইসিসি ট্রফি জেতার পর আমি প্রকাশ্যে ২০০০ সালকে টেস্ট মর্যাদা অর্জনের বছর হিসেবে ঘোষণা দেই। বাস্তবে ঘরোয়া ক্রিকেট প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার আগেই টেস্ট মর্যাদা অর্জন করি আমরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার আলি বাখের, অস্ট্রেলিয়ার ডেনিস রজার্স ও অবশ্যই জগমোহন ডালমিয়ার মত সেরা ক্রিকেট ব্যবস্থাপকরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের সাথে সেসময় আইসিসির সদস্য হতে পারাকে আমি অনেক বড় সম্মান হিসেবে মনে করি।
তখন শুধু টেস্ট মর্যাদাই নয়, এর অল্প কয়েক মাস পরই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মত টেস্ট খেলে বাংলাদেশ দল। আমাদের জাতীয় দলের কোচ এডি বারলো তখন আমাকে চিন্তিত দেখে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, “আমাদের ছেলেরা ভালোই খেলবে মিস্টার প্রেসিডেন্ট—দুশ্চিন্তার কিছু নেই!” কোচের আশ্বাসমতো ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে আমিনুল ইসলামের দুর্দান্ত শতক ও বোলিংয়ে নাইমুর রহমান দুর্জয় নৈপুণ্য দেখান।
মাত্র চার বছরের মধ্যে এই বিশাল অর্জন এখনও যখন পেছন ফিরে দেখি আমাকে অভিভূত করে। এই স্বপ্নময় যাত্রা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র আমাদের সাহসী স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের সৌন্দর্যে বিশ্বাস ও সর্বোপরি আমরা যে সফল হতে পারি এর ওপর পূর্ণ আস্থার ফলে।
টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন কখনোই আমাদের শেষ লক্ষ্য ছিলো না বরং আমাদের লক্ষ্য- বাংলাদেশ এক দিন ক্রিকেট খেলা দেশগুলোর মধ্যে সেরা ও সর্বোচ্চ সম্মানজনক স্থান অর্জন করবে, তার একটা উপায় হলো টেস্ট স্ট্যাটাস। আজ বাংলাদেশ যখন কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শততম টেস্ট খেলছে তখন আমাদের আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে দলের শৈশব পার করে কৈশোরের ১৫০তম ও ২০০তম টেস্টে কোথায় দেখতে চাই আমরা টিম বাংলাদেশকে।
সতেরো বছরে ৯৯ টেস্টে আটটি জয় খুব বড় সাফল্য না হলেও এই সময়ের মধ্যে আমরা এমন অনেককেই পেয়েছি যারা আমাদের আশার প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রেখেছেন। কঠোর পরিশ্রম, অঙ্গীকার, মাঠের বাইরে সুশাসন ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকার মধ্যদিয়ে ওই আশার প্রদীপটি নিয়ে নতুন দিনের সূচনা করতে হবে আমাদের।
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ
Comments