ক্ষমতাহীন হতে চান যে প্রেসিডেন্ট

Maithripala Sirisena
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। ছবি: সংগৃহীত

মনে হতে পারে কোনো এক রূপকথার গল্প বলছি! ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিনসহ বর্তমান বিশ্বে অনেক নেতা যখন নিজ নিজ দেশে নিজেদেরকে আরও ক্ষমতাবান করতে নানামুখী আয়োজনে ব্যস্ত সেসময়ে আমাদের পাশের দেশে একজন রাষ্ট্রপতি নিজের অনেক ক্ষমতা কেটে-ছেঁটে ফেলেছেন। এমন কি সব ক্ষমতা অন্যদের উপর দিয়ে তিনি নিজেকে ক্ষমতাহীন করতে চেয়েছিলেন! রাষ্ট্রপতি পদকে আলংকারিক পদে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্যদের বিরোধিতার মুখে তাঁর ইচ্ছার পুরো বাস্তবায়ন হয়নি। সেই ব্যক্তি এখন আমাদের ঢাকা শহরে। তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।

২০১৫ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে তাঁর বিজয় বিস্ময় হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। ক্ষমতার অবারিত অপব্যবহার, লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ এবং সর্বোপরি দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েমের সকল আয়োজন যখন সম্পন্ন ঠিক সে সময়ে তাঁর বিস্ময়কর উত্থান। নির্বাচনের ময়দানে নেমে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কর্তনসহ জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নে তিনি কালক্ষেপণ করেননি। এপ্রিল মাসেই সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল পাশ করে রাষ্ট্রপতির একক এবং অসীম নির্বাহী ক্ষমতা কর্তন করেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল যে, রাষ্ট্রপতির সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে থাকা মন্ত্রিসভার কাছে হস্তান্তর করা। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শে কাজ করবেন; ওয়েস্টমিন্সটার মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্রের আদলে। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। ক্ষমতার ভারসাম্য বজার রাখার জন্যে কেউ কেউ প্রেসিডেন্টকে একদম ক্ষমতাহীন করতে রাজি হননি। ফলে মূল প্রস্তাবে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তারপরও রাষ্ট্রপতির যে পরিমাণ ক্ষমতা কর্তন করা হয়েছে তা বিরল উদাহরণ হয়ে থাকবে অনেক বছর।

তাঁর পূর্বসূরি রাজাপাকসে ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধন করে নিজের ক্ষমতা সংহত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে যতবার খুশি নির্বাচিত হওয়ার বিধান করেছিলেন। সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দানের একক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছিল। সংসদ, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপের পথ অবারিত হয়েছিল। সে ক্ষমতার ব্যবহার এবং সংসদকে প্রভাবিত করে রাজাপাকসে ২০১৩ সালে দেশের প্রধান বিচারপতিকে অভিশংসন করেছিলেন। সেসময় অভিযোগ উঠে যে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট রাজাপাকসের স্বার্থ-বিরোধী রায় দেওয়ায় এমন ঘটেছে। সুপ্রিম কোর্ট সে সময়েই অভিশংসনকে অবৈধ ঘোষণা করে।

কিন্তু ২০১৫ সালের সংবিধান সংশোধনে ক্ষমতার পুনর্বণ্টন করা হয়েছে। সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের বিধান চালু করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেউ দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। সংসদ, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করতে রাষ্ট্রপতির আগের ক্ষমতা কাটা হয়েছে। কয়েকটি স্বাধীন কমিশন গঠনের বিধান করা হয়েছে যাতে বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, ও বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ ছয় বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে।

শপথ নেওয়ার পরই সিরিসেনা ঘোষণা করেন যে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে নামবেন না। দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি তাঁকে হিজ এক্সিলেন্সি এবং তাঁর স্ত্রীকে ফার্স্ট লেডি হিসেবে সম্বোধন না করতে জনগণের প্রতিও আহবান জানান। তাঁর এ ঘোষণাও কি ইংগিত করে না যে ক্ষমতার প্রতি তার মোহ নেই?

মজার বিষয় হল, সিরিসেনা ২০১৪ সালের নভেম্বরের আগ পর্যন্ত রজাপাকসের মন্ত্রিসভায় ছিলেন। নভেম্বরে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে রাজপাকসের বিপক্ষে নির্বাচনে নামার ঘোষণা দেন। কারণ হিসাবে তিনি রাজাপাকসে ও তাঁর সরকারের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বৈরশাসন কায়েমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তোলেন। রাজাপাকসের দলের নেতারা সিরিসেনাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু তাঁর পদত্যাগ এবং নির্বাচনে রাজাপাকসে চ্যালেঞ্জ করার ঘোষণায় দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্য বদলে যেতে থাকে। অন্য সকল বিরোধী দল তাঁর পক্ষে জোটবাঁধে। রাজাপাকসের বিরুদ্ধে তিনি সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসাবে আবির্ভূত হন। সকলের যৌথ চেষ্টায় তিনি বিজয়ী হয়। অবসান ঘটে রাজাপাকসের এক দশকের শাসন। তাঁর বিজয় দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা কর্তন এবং মন্ত্রিসভার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর জনগণকে আশান্বিত করে তোলে। শুরু হয় শ্রীলংকার নতুন অধ্যায়। আসলেই এ যেন এক রূপকথার গল্প! ক্ষমতার প্রতি মোহ না থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। সিরিসেনা আগামী দিনের রাজনীতিতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago