ঢাকায় ইয়াবা বাণিজ্য: সরষের মধ্যেই ভূত

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাজধানীতে ইয়াবা ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে। শুধু তাই নয়, মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কথা সেই পুলিশেরই অসাধু একটি অংশ এই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পুলিশের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে মাদক ব্যবসার চালচিত্রের বিষয়টি উঠে এসেছে।
মাদক বেচাকেনা হয় এমন অনেক জায়গায় কিছু অসাধু পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বরত রয়েছেন। দায়িত্ব পালনের নামে তারা ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কোনভাবে বদলি ঠেকিয়ে রেখে তারা একই এলাকায় দীর্ঘদিন রয়ে যাচ্ছেন।
গত কয়েক মাস আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি প্রতিবেদনে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত প্রায় ১০০ জন গডফাদারের নাম উঠে আসে। তালিকায় দেখা যায় যাদের ছত্রছায়ায় মাদক বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা চলে তরা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সাথে যুক্ত।
ডিএমপির তালিকাটিতে দুজন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাসহ বেশ কয়েকজন অসাধু পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার নাম রয়েছে।
মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি ইয়াবা সাধারণত বড়ি আকারে সেবন করা হয়। বর্তমানে এর ব্যবহার এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে ডিএমপির ছয়টি ক্রাইম ডিভিশন—উত্তরা, গুলশান, রমনা, তেজগাঁও, মিরপুর ও মতিঝিলে প্রতিদিন ৩৮ হাজার ইয়াবা বড়ি সেবন করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়েছে।
অন্য দুটি ক্রাইম ডিভিশন ওয়ারি ও লালবাগে কি পরিমাণ ইয়াবা সেবন হচ্ছে সে ব্যাপারে পুলিশের গোয়েন্দারা অনুমান করে উঠতে পারেনি। তবে এই দুটি এলাকাও ইয়াবা বেচাকেনার দিক থেকে ব্যতিক্রম নয়।
জব্দ হওয়া ইয়াবার পরিমাণ থেকে বাংলাদেশে কত দ্রুত মাদকটির ব্যবহার ও ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে ২০১১ সালে দেশে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ইয়াবা বড়ি জব্দ করা হয়েছিল। আর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনী ২০১৬ সালে দুই কোটি ৯৬ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছে। এই হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে জব্দ হওয়া ইয়াবার পরিমাণ ২২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ধারণা করা হয় বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৯ কোটি ৪৫ ইয়াবা বড়ি সেবন করা হচ্ছে। যার মূল্য প্রায় সাত হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা যা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ খরচের প্রায় দুই গুণ। প্রতিটির দাম ২৫০ টাকা ধরলে প্রতিদিন আট লাখের বেশি ইয়াবা সেবন করা হয় বাংলাদেশে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার (গোয়েন্দা) দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ঢোকে তার মধ্যে মাত্র আট থেকে ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। এর বেশিরভাগই আসে মিয়ানমার থেকে।
মিয়ানমারের সীমান্তের যেসব এলাকায় আইন প্রয়োগকারীদের নজরদারি নেই সেসব এলাকায় ল্যাবে ইয়াবা তৈরি করে বাংলাদেশে পাচার করা হয়। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভেতরেও স্বল্প পরিমাণে ইয়াবা তৈরি করা হয়েছে বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছে। ইয়াবা তৈরিতে যেসব উপাদান লাগে সেসব পাচার করে এনে তারা এটা করেছে।
বাংলাদেশকে ইয়াবা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ইয়াবা পাচারের জন্য চোরাচালানিরা বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বিমানবন্দর থকে ইয়াবার দুটি চালান জব্দ হয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এগুলো দুবাই পাঠানো হচ্ছিল।
একজন ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তি দিনে ১০ থেকে ১২টি পর্যন্ত বড়ি সেবন করতে পারেন। এই পরিমাণ নির্ভর করে আসক্তির মাত্রার ওপর। মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করেন এমন একজন চিকিৎসক জানান, এমন অনেকে রয়েছে যারা দিনে মাত্র একটি ইয়াবা বড়ি সেবন করেন।
মাদকসেবীদের মধ্যে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে অনেকেই এক পর্যায়ে মাদকটির বেচাকেনার মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের কারণেই ইয়াবার জনপ্রিয়তা এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।
পুলিশের তালিকা
ডিএমপির তথ্য মতে, ঢাকার ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে ১৬ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ও একজন বিএনপির।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটিগুলোর তিনজন সভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক ও থানা কমিটির একজন সাধারণ সম্পাদক মাদক ব্যবসা চক্রের সাথে যুক্ত। শুধু এরাই নয় থানা পর্যায়ে যুবলীগের দুজন সভাপতি, ছয়জন সাধারণ সম্পাদক ও থানা কমিটি ছাত্রলীগের দুজন সাধারণ সম্পাদকের নাম রয়েছে পুলিশের তালিকায়।
থানা, ওয়ার্ড ও নগর কমিটি স্বেচ্ছাসেবকলীগের অন্তত সাতজন নেতাসহ বাস্তুহারালীগ ও তাঁতিলীগের নেতাদের নামও মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় উল্লেখ করেছে পুলিশ।
পুলিশের মধ্য থেকে যারা ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের মধ্যে দুজন সহকারী পরিদর্শক রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন নগরীর একটি থানার ও অন্যজন খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে দায়িত্বরত। টহল পুলিশেরও কিছু সদস্য হোতাদের তালিকায় রয়েছেন।
এ বাদেও যাদের হাত দিয়ে ইয়াবা বিক্রি হয় এমন প্রায় এক হাজার একশ জনের নামসহ বিস্তারিত তথ্যসম্বলিত তালিকা বানিয়েছে ডিএমপি। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, তালিকাটি পুলিশ সদর দপ্তরসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই তালিকার একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।
Comments