রোহিঙ্গাদের গ্রামে আসলে কারা আগুন দিচ্ছে?
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী সহিংস অভিযান চালাচ্ছে। নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। হাজারো মানুষের এই স্রোত এখনো অব্যাহত রয়েছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, রাখাইনে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। সেই সাথে স্থানীয় অন্যদের সহযোগিতায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেওয়া এসব গ্রাম থেকে ওঠা ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেও দেখা গেছে। অথচ সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা নিজেরাই তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। এর ‘প্রমাণ’ হিসেবে তারা কিছু ছবিও দিয়েছে যেখানে লোকজনকে বাড়িতে আগুন দিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যাদেরকে বাড়িতে আগুন দিতে দেখা যাচ্ছে তারা কি আসলেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা?
আসল তথ্য বলছে মিয়ানমারের এই দাবি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ১৮ জন সাংবাদিককে রাখাইন রাজ্যের অবস্থা দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই অঞ্চলে সাংবাদিকদের প্রবেশে আগে থেকেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে সরকার। এই সাংবাদিকদেরও নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতেই নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা কার সাথে কথা বলতে পারবেন আর কার সাথে কথা বলতে পারবেন না সেটাও বলে দেওয়া ছিল। এক কথায় সব কিছুই ছিল পূর্ব নির্ধারিত। ফলে স্বাধীনভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার খুব সামান্যই সুযোগ পেয়েছিলেন সেই সাংবাদিকরা। এর মধ্যেও তারা সেখানকার লোকজনের সাথে কথা বলে ও দেখে যা জানতে পেরেছেন তাতে মিয়ানমার সরকারের মিথ্যাচার, নিপীড়ন ও রোহিঙ্গা গ্রামে আগুন দেওয়ার বিষয়টিই উঠে এসেছে।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওই সফরে বিবিসির দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংবাদদাতা জোনাথন হেড ছিলেন। রাখাইনের যেসব এলাকায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে তিনি দেখেছেন গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজনের সাথে কথা বলে তিনি যেমন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কারণে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের ভোগান্তির কথা জেনেছেন তেমনি শুনেছেন হুমকির মুখে লোকজনকে সরকারি ভাষ্য আওড়াতে।
রাখাইনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন জোনাথন হেড। তিনি লিখেছেন, রাখাইনের রাজধানী সিটউইতে পৌঁছানোর পর তাদের সবাইকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। বলা হয়, দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ কোথাও যেতে পারবেন না। এর জন্য তাদের নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয়, তাদেরকে যেসব এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে সেখানে সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ চলছে। ফলে সন্ধার পর কোথাও যাওয়া যাবে না।
এত প্রতিবন্ধকতার কথা শোনার পর স্বাধীনভাবে তদন্ত চালানোর ব্যাপারে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েন সাংবাদিকরা।
সেনাবাহিনী যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে সেসব এলাকায় যাওয়ার বর্ণনা উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। তিনি লিখেছেন, যাত্রার বেশিরভাগ সময়ই নদী পথে নৌকায় ঠাসাঠাসি করে তাদের যেতে হয়েছে। রাখাইনের রাজধানী সিটউই থেকে বুথিডং যেতে লেগেছে ছয় ঘণ্টা। সেখান থেকে ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে মায়ু হিল পার হয়ে তারা মংডুতে গিয়ে পৌঁছান। শহরে ঢোকার মুখে তারা প্রথম একটি গ্রাম দেখেন যেটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিও থু গি নামের ওই গ্রামটির পাম গাছগুলোও আগুনের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
মংডুতে তাদের প্রথম একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাস্তুচ্যুত অনেক হিন্দু পরিবারকে ওই স্কুলে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তাদের সবার গল্পই প্রায় এক রকম ছিল। তারা বলেছেন, কিভাবে মুসলমানরা তাদের ওপর আক্রমণ করেছেন। অনেকেই ভয় থেকেও সেখানে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই ভিন্ন কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে মিল থাকার কারণেই তারা সরকারি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
সাংবাদিকরা যতক্ষণ ওই স্কুলটিতে ছিলেন ততক্ষণ অস্ত্রধারী পুলিশ তাদের পাশে পাশে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে কেউ মন খুলে কথা বলবে এমন সম্ভাবনা ছিল খুবই সামান্য। এর মধ্যেও একজন বলতে শুরু করেন কিভাবে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে এসে গুলি চালায়। কিন্তু সাথে সাথে আরেক জন তার কথা সংশোধন করে দেন।
সেখানে কমলা রঙের কাপড় পারা এক নারী ছিলেন যিনি খুব উৎসাহের সাথে রোহিঙ্গাদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার কথা বলছিলেন। সীমান্তের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্নেল ফোনি টিন্ট নামের একজন কর্মকর্তা বলেন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা কিভাবে আশপাশের গ্রামের দখল করে নেয়। তাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে একজন করে যুবককে তাদের সাথে যোগ দিতে বলে। যারা তাদের কথা শোনেনি তাদেরই বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মাইন বসিয়ে তারা তিনটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছে এমন অভিযোগও করেন কর্নেল ফোনি।
সেনাবাহিনীর নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, “এর প্রমাণ কোথায়? যারা এই অভিযোগ তুলছে সেই মেয়েদের (রোহিঙ্গা) দেখে বলুন, কেউ এদের ধর্ষণ করতে চাইবে?”
এর পর ওই সাংবাদিকদের একটি বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন ভিক্ষু বর্ণনা করেন, কিভাবে মুসলিমরা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। অগ্নিসংযোগের ছবিও তাদের দেখানো হয়। কিন্তু ছবিগুলো ছিল অদ্ভুত।
ছবিতে দেখা যায় সাদা টুপি পরা কিছু লোক একটি ঘরের চালায় আগুন দিচ্ছে। ওখানেই এক নারী নাটকীয় ভঙ্গিতে হাওয়ায় দা ঘোরাচ্ছে। তাদের একজনের মাথায় টেবিলক্লথের মতো লেসের কাজ করা কাপড় ছিল।
জনাথন হেড লিখেছেন, “এর পর আমি দেখলাম, ছবিতে দা হাতে থাকা ওই নারী হচ্ছেন স্কুলে থাকা সেই হিন্দু নারী যিনি রোহিঙ্গাদের হাতে নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। আর ঘর পোড়ানো পুরুষদের মধ্যে একজনকে আমি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া সেই বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে দেখেছি।”
“এর মানে হল, তারা এমনভাবে কিছু ভুয়া ছবি তুলেছে, যাতে মনে হয় রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে।”
মংডুতে যেসব মুসলিমদের সাথে সাংবাদিকরা কথা বলেছেন তারা কেউ ক্যামেরার সামনে কথা বলার সাহস করননি। পুলিশের নজর এড়িয়ে এদের যে কজনের সাথে কথা হয় তারা সবাই জানায় নিরাপত্তা বাহিনী গ্রাম ছাড়তে দিচ্ছে না তাদের। খাবারের অভাব ও তীব্র আতঙ্কের মধ্যে তাদের দিন কাটছে।
একজন যুবক বলেন, তারা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের নেতারা চলে না যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি করেছে। এখানকার রোহিঙ্গা বাজার এখন নীরব। একজনকে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কিসের ভয় করছেন? তিনি জবাবে বলেন, “সরকার”।
সেখান থেকে আরেকটি এলাকায় যাওয়ার পথে তারা গ্রামের পর গ্রাম দেখেছেন যেগুলো ছিল সম্পূর্ণ ফাকা। তাদেরকে বলে হয় দুই সপ্তাহ আগে বাঙালি সন্ত্রাসীরা এই এলাকাগুলোতে আক্রমণ করে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। কিন্তু সেই ঘটনার এত দিন পর এবং বৃষ্টির মধ্যেও কিছু জায়গায় আগুন জ্বলছে কেন - এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইতস্তত করে বলা হয়, হয়তো কিছু মুসলিম এখনো রয়ে গেছে এবং চলে যাবার আগে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে গেছে।
ফেরার পথে এমন কিছু ঘটে যা সফরের আয়োজকদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তারা দেখেন, রাস্তার পাশেই একটি ধানক্ষেতের ওপারে গাছের ভেতর থেকে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছে। বোঝাই যায়, আগুনটা লেগেছে এই মাত্র। আগুন দেখামাত্র তারা চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলেন।
“গাড়ি থামতেই সাথে থাকা সরকারি লোকজনকে ফেলে যেখান থেকে ধোঁয়া উঠছিল সেদিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। পুলিশও আমাদের পিছু পিছু এলো। তারা বলেন, গ্রামের ভেতরে যাওয়াটা নিরাপদ হবে না। পুলিশের কথা কানে না তুলে আমরা এগিয়ে গেলাম।”
বাড়িতে আগুন লাগলে যেমন শব্দ হয় চারদিক থেকে সেরকম শব্দ আসছিল। ওখানে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা কাপর দেখা বোঝা যাচ্ছিল সেগুলো ছিল মুসলমান নারীদের কাপড়।
পাশেই রাস্তায় কয়েকজন পেশীবহুল যুবক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল তলোয়ার এবং দা। ১৮ জন সাংবাদিককে দিকে দৌড়ে আসতে দেখে তারা প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। সাংবাদিকরা যাতে এই ঘটনাটি ভিডিও করতে না পারে তারা সে চেষ্টাও চালায়। দুজন দৌড়ে গ্রামের আরো ভেতর দিকে চলে যায় ও অন্য একজনকে নিয়ে দ্রুত ওই জায়গা থেকে সরে পড়ে।
কথা বলে জানা যায় তারা রাখাইন বৌদ্ধ। পুলিশের সাহায্য নিয়েই বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়েছে এমন কথাও স্বীকার করে ওই যুবকদের একজন।
কিছু দূরে আরেকটি মাদরাসার চালা জ্বলছিল। ওর আশপাশেই পড়ে ছিল আরবি বইপত্র। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এই গ্রামটির নাম গোয়াদু থর ইয়া। এখানে অন্য কারও দেখা মেলেনি। পুড়িয়ে দেওয়া এই গ্রামটির পাশেই একটি পুলিশ ফাঁড়ি চোখে পড়ে। অথচ সেখানে কেউ হামলার চেষ্টা করেনি।
Comments