চলতি বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যু ৪৮

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে সারা দেশে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে সারা দেশে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

আজ শুক্রবার আসকের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামালের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

দেশের ১০টি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ ও আসক-এর নিজস্ব সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ সংখ্যাগত প্রতিবেদনটি তারা তৈরি করে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং 'ক্রসফায়ারে' মোট ৪৮ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ', 'গুলিবিনিময়' ও 'এনকাউন্টারে' নিহত হন ৩৪ জন। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ৯ জন ও নির্যাতনে মারা গেছেন ৪ জন। এ ছাড়া, গ্রেপ্তারের পরে হার্ট অ্যাটাকে (পুলিশের ভাষ্যমতে) একজনের মৃত্যু হয়।

কারা হেফাজতে মৃত্যু

পাশাপাশি বছরের প্রথম ৯ মাসে কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ৬৭ জন। তাদের মধ্যে কয়েদি ২৫ জন এবং হাজতি ৪২ জন।

অপহরণ-গুম 

গত ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন ৬ জন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৩ জন।

সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি

গত ৯ মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক জন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং ১৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৮ জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন। 

এ ছাড়া ১০৬ জন সাংবাদিক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা

এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা গত বছরের ৯ মাসের তুলনায় বেড়েছে।

এই ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৮৫ নারী, যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৭৯ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৩ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৩৯ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৮ নারী। 

এ ছাড়া, ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৫৬টি। তবে, গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৯৭৫ জন নারী।  

এই ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১০১ নারী, তাদের মধ্যে ১০ নারী আত্মহত্যা করেছেন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন ৩ নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৭১ জন পুরুষ, যার মধ্যে ৪ জন পুরুষ খুন হয়েছেন।

এ বছরের ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২৭ নারী। যাদের মধ্যে স্বামী, স্বামীর পরিবার এবং নিজ পরিবার কর্তৃক হত্যার শিকার হন ৩০৩ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যা করেছেন ১১৮ নারী। উল্লেখ, গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪৩২ নারী।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন মোট ১৮২ নারী। যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৮ জন।

এ সময়ের মধ্যে ৩৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। যাদের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ১২ জন এবং ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৬ গৃহকর্মী ।

এ সময়ে সালিশ ও ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ১২টি। এছাড়া এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ১৯ নারী।

শিশু নির্যাতন ও হত্যা

শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। গত ৯ মাসে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৬৩৬ শিশু। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয় ৪৭১ জন এবং শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয় এক হাজার ১৬৫ শিশু। এই ১ হাজার ১৬৫ জনের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৬৪৮ কন্যাশিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৬৪ জন ছেলে শিশু। 

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের এই সময়কালে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল এক হাজার ৫২৩ শিশু।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন

এ সময়ের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০২টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৭৮টি। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ জন। জমি ও বাড়িঘর দখল এবং উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এ ছাড়া, বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পরিবার ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে একটি। 

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের এই সময়কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ৪৮টি প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামন্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সীমান্ত সংঘাত

এই সময়কালে ভারত সীমান্তে মোট নিহত হয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে ৯ জন, শারিরিক নির্যাতনে ১ জন এবং বিএসএফ-এর ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে ১জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৬ জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩ জন।  

রাজনৈতিক সংঘাত

গত নয় মাসে প্রধান প্রধান জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩২১টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ১৬৭টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৯৪২ জন এবং নিহত হন ৩০ জন।

গণপিটুনি

এ সময়কালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন মোট ২৬ জন নাগরিক। উল্লেখ্য, গত বছর (২০২০) এই সময়কালের মধ্যে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৩০ জন।

আসকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়কালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, 'ক্রসফায়ার', 'গুলিবিনিময়' বা 'বন্দুকযুদ্ধের' মাধ্যমে অনেক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।

অন্যদিকে, ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে ঘটে চলেছে। এ ছাড়া মতপ্রকাশের অধিকার হরণসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গণমাধ্যমকর্মীসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ সময়কালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষত আসন্ন দুর্গাগূজাকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো এবারও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে।

গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক নিহত এবং অন্তত ৩৫ জন আহত হন। কারাখানা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টগ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং শ্রম আইনের লংঘনের ফলে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে বলে বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০ সেপ্টেম্বর সারা দেশে ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, ভোটের আগেই বাগেরহাট, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৪৩টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর মধ্যে বাগেরহাটে ৬৬টি ইউপির মধ্যে ৩৮টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। বাকি ২৮ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বী নিজ দলেরই বিদ্রোহীপ্রার্থী। প্রথম পর্যায়ের ইউপি নির্বাচনের আগের অংশেও একই চিত্র দেখা গেছে। ২০৪ ইউপিতে ২১ জুনের নির্বাচনে ২৮ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও ভোটারবিহীন স্থানীয় নির্বাচন নাগরিকের ভোটাধিকার হরণসহ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে বলে আসক মনে করে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সংগ্রামরত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ায় লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন।

 

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

15h ago