‘আইনের শাসন নেই বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে’

বরিশালে ইউএনওর বাসায় হামলা এবং রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের বিপরীত অবস্থানের ঘটনাটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ—প্রত্যেকেই এই ঘটনাটিকে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন। বরিশালের এই ঘটনা অনেক প্রশ্নের উদ্রেগ ঘটিয়েছে।
ড. তোফায়েল আহমেদ ও আলী ইমাম মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

বরিশালে ইউএনওর বাসায় হামলা এবং রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের বিপরীত অবস্থানের ঘটনাটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ—প্রত্যেকেই এই ঘটনাটিকে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন। বরিশালের এই ঘটনা অনেক প্রশ্নের উদ্রেগ ঘটিয়েছে।

বরিশালে যে ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দৃশ্য দেখা গেল, এই পরিস্থিতি কবে থেকে শুরু? এ ঘটনায় দেওয়া বিবৃতিতে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, 'বরিশালে মেয়রের নেতৃত্বে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। মেয়রের অত্যাচারে বরিশালবাসী অতিষ্ঠ।' প্রশাসন কি এতদিন তা জানত না? জানলে চুপ ছিল কেন? প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের এই বিপরীত অবস্থানের কারণ কী? এ থেকে সারা দেশের রাজনীতির কী বার্তা পাওয়া যায়?

দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের সঙ্গে।

শুধু বরিশালে নয়, সারা দেশেই এ ধরনের ঘটনা কোনো না কোনোভাবে ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমাদের রাজনৈতিক দলের লোকজন অতিরিক্ত ক্ষমতাবান হয়ে গেছে। মানে তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে কাজ করার মানসিকতা প্রকট হয়ে গেছে। যে কারণে তারা আইন-কানুন মানছে না। আর স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে তো প্রশাসনিক নিয়ম-নীতি, দেশের স্থিতিশীলতা বোঝার মানসিকতা নেই। কারণ, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চর্চাই নেই। ফলে ইচ্ছামতো সবকিছু করার মানসিকতা প্রবল হয়ে গেছে। যেই সামনে পড়ে, তার ওপরেই তারা হামলা করছে। ধরেন এই সংঘর্ষ যদি বিএনপির সঙ্গে হতো, তাহলে এটা নিয়ে তো কোনো কথাই হতো না। মেরে সাফ করে দিত। এখন প্রশাসনের সঙ্গে হয়েছে বলে আলোচনায় এসেছে।'

বরিশালে এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বিষয়ে এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলেন, 'বরিশালের এখনকার মেয়রের বাবা হাসনাত আবদুল্লাহ বরিশালে কাউকে কথা বলতে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রথমবারের আমলে? তখন থেকেই তো তিনি সেখানে ত্রাস কায়েম করেছিলেন। তো তাদের সেখানকার রাজনীতির এই অবস্থাই তো হবেই। এখনকার মেয়রের অবস্থাও তো এমনই হবে।'

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, 'বিবৃতিতে তারা যেটা বলেছে, সেটাও কিন্তু রাজনৈতিক কথা হয়ে গেল। তাদের উচিত ছিল প্রশাসনিক ভাষায় কথা বলা। কিন্তু, তারাও একটা রাজনৈতিক দলের মতো হয়ে গেছে। তাদের কথাটা হওয়া উচিত ছিল, "এটা নিয়ে তদন্ত হোক। তদন্তে যারা দোষী হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।" তাদের উচিত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করা। কিন্তু, তারা কি সেটা করছে?'

'প্রশাসন যদি অবজেকটিভলি কাজ করে, তাহলে তো কে কোন দলের লোক, তা দেখার কথা নয়। বরিশালে যেটা হলো, বেশ কিছুদিন আগে তা পাবনাতেও হয়েছে। এসব পরিস্থিতির পেছনে কিন্তু প্রশাসনও দায়ী। কারণ, তার রাজনৈতিকভাবে কথা বলে, নেতাদের তোয়াজ করে, সুবিধা নেয়। প্রশাসন যদি আইনের শাসন বজায় রাখতে কাজ করত, তাহলে তারা নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করত। কিন্তু, তারা তো ব্যক্তি শাসন বজায় রাখার জন্যে কাজ করছে। ফলে রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে কোনো সীমারেখা নেই। যে কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকবে', বলেন তিনি।

প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের বিপরীত অবস্থান বিষয়ে তিনি বলেন, 'বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বই কিন্তু প্রশাসনের ওপর গিয়ে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে, এমপির এক ধরনের চাহিদা, আবার মেয়রের আরেক ধরনের চাহিদা। সে কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত হচ্ছে। এখনকার দ্বন্দ্বটাও তো প্রশাসনের সঙ্গে মেয়রের নয়। আরেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে মেয়রের দ্বন্দ্ব। মেয়র ভাবেন তিনি সেখানকার রাজা। তার কথা ছাড়া কেন এটা হলো। সে কারণেই হয়তো তিনি ইউএনওর ওপর গিয়ে চড়াও হয়েছেন।'

বরিশালের রাজনীতিতে আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষ দেখা গেছে। তখন বিএনপি বলেছে, প্রশাসনের কারণে সেখানে তারা কোনো ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারে না, ঘরে থাকতে হয়। এখন তো সবকিছু প্রশাসন চালাচ্ছে। সে কারণেই কি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘর্ষের এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখনো রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন ভাগাভাগি করে সব চালাচ্ছে। প্রশাসন উপরের দিকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু, রাজনীতিবিদরা যা আদায় করার তা ঠিকই নিচ্ছে। এখন প্রশাসন রাজনীতিবিদদের আজ্ঞাধীন হয়ে কাজ করছে। কিন্তু, আজ্ঞাধীন হলেও সব কিছু তো সবভাবে করা যায় না। কিছু জিনিস নিয়মের মধ্য দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে করতে হয়। কিন্তু, এখনকার বরিশালের মেয়র ওই নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে যেতে চায় না। তারা জোর করে করতে চায়।'

'সবকিছু তো মেয়রের দেখার কথা নয়। মেয়রের কাজ কী, এর সুনির্দিষ্ট আইন আছে। সিটির মধ্যে আরবান সার্ভিস দেওয়াটা মেয়রের কাজ। ল অ্যান্ড অর্ডার নিয়ন্ত্রণ করা তার কাজ নয়। জনপ্রতিনিধি হলেই সব কাজ তো তার নয়। কিন্তু, আমাদের মেয়র চায় সব তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে', বলেন তিনি।

বাংলাদেশে রাজনীতির সঠিক চর্চা নেই উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'এরকম পরিস্থিতির মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, দেশে প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন নেই। আইনের শাসন থাকলে এগুলো হয় না। কেউ বাড়াবাড়ি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আইনের শাসন আনাটাই আসল কাজ। সব সময় যে আইনের শাসন শতভাগ থাকবে সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। কোনো দেশেই তা হয় না। কিন্তু, ৭০-৮০ ভাগ অন্তত থাকতে হবে। তাহলে রাজনীতি ও প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করতে পারবে এবং জনগণও নিরাপদ থাকবে।'

'আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির মধ্যে বড় ধরনের অবক্ষয় হয়েছে। আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে হলে এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। এটা ছিল। কিন্তু, এখন সেটার অবক্ষয় হচ্ছে। ফলে আইনের শাসন ব্যাহত হচ্ছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি শোধরাতে হবে', যোগ করেন তিনি।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, 'মাঠে প্রশাসনের যেমন কাজ আছে, তেমনি রাজনীতিবিদদেরও আছে। এখন একজন আরেকজনের অবস্থান ছাড়িয়ে যদি কাজ করতে যায়, তাহলেই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমি যতটুকু জানি বুধবার রাতে বরিশাল মেয়রের লোকেরা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে ব্যানার খুলতে ঢুকেছে। পরে ইউএনও বলেছেন যে রাতে কেন, পরের দিন সকালে এ কাজ করতে। এরপরই তার বাড়িতে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে। আনসার কর্মকর্তারা বাধা দিতে গেলে তাদের ওপরেও হামলার ঘটনা ঘটে।'

'এখানে আমার মনে হয়েছে, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের লোকেদের সেখানে পাঠানোর কাজটা মেয়র ঠিক করেন নাই। সেখানে পোস্টার খুলতে লোক পাঠানোর আগেও কিন্তু তিনি ইউএনওর সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তিনি তার পদবিকে অবমাননা করেছেন। এ ঘটনায় হওয়া দুটি মামলাতেই মেয়র প্রধান আসামি। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা আশা করব মেয়রের বিরুদ্ধেও যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যদি ইউএনওর কোনো অপরাধ থেকে থাকে, তদন্ত করে যদি তা পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে', বলেন তিনি।

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

প্রশাসন সব চালাচ্ছে বলেই কি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাদের এরকম সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'একটা বিষয়টি বুঝতে হবে যে, প্রশাসন কিন্তু জেনেও অনেক কিছু করতে পারে না। যেমন: গণমাধ্যমও কিন্তু অনেক কিছু লিখতে পারে না। অর্থাৎ একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তা নিয়েই তো সবাইকে কাজ করতে হচ্ছে।'

প্রশাসন-রাজনীতিবিদদের বিপরীত অবস্থান ও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে পাওয়া বার্তার বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, 'সারাদেশেই এক ধরনের অসহিষ্ণু রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। দেশে অনেক ভালো রাজনীতিবিদ আছেন, যারা প্রশাসনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন। আবার এর বিপরীতও রয়েছে। তেমনি প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও মাঝেমধ্যে ঝামেলা বাধিয়ে ফেলে। তবে, বরিশালের চিত্রটা ভিন্ন। এই মেয়রের সময়েই একাধিক ঘটনা ঘটেছে যেগুলো অনুচিত। এগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।'

সবশেষে তিনি বলেন, 'আমি চাই বরিশালের এই ঘটনায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যে দোষী তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।'

উল্লেখ্য, গত বুধবার বরিশালে ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে ইউএনওর বাসায় হামলা চালানো হয় এবং আনসার ও পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়ের করা দুটি মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে। পুলিশ এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় আজ ইউএনওর বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

12h ago