কুমিল্লায় ঘৃণা থেকে শুরু হওয়া সহিংসতার সময়চিত্র

শারদীর দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে ৩০ বছর বয়সী একরাম হোসেন ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির পাড় পূজা মণ্ডপে কথিত কোরআন 'অবমাননা'র বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করেন।
এর কয়েক মিনিটের মধ্যে মণ্ডপে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাদা পোশাকে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি একা গিয়েছিলেন।
পরে ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে ফয়েজ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি মণ্ডপ থেকে ফেসবুক লাইভে এসে কথিত অবমাননার প্রতিবাদের জন্য লোকজনকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান। তার ৫৬ সেকেন্ডের ফেসবুক লাইভে তিনি ওসি আনোয়ারুল আজিমকেও দেখিয়েছিলেন।
দ্রুত যুবকদের কয়েকটি দল এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়। তারা ফেসবুকে ভিডিওটি শেয়ার করতে শুরু করে। ৮টার ভেতর লোকজন মণ্ডপে আসতে থাকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেখানে শ'খানেক মানুষের ভিড় জমে যায়।
এর মধ্যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এমরান বাচ্চু ভিড় ঠেকাতে মণ্ডপের চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন।
এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান ও জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ফারুক আহমেদ ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে পুলিশের ৪০ থেকে ৫০ জন সদস্যসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বাড়ি মণ্ডপ থেকে ৩০০ গজ দূরে হলেও তিনি সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য তাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অনুরোধ করেছিল। কর্মকর্তারা তাকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ১০টার আগে তিনি সেখানে যাননি।
ডিসি, এসপি, কাউন্সিলর বাচ্চু, সৈয়দ আহমেদ সোহেল নামের একজন প্যানেল মেয়র এবং স্থানীয় মসজিদের কয়েকজন ইমাম পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু লাল জার্সি পরিহিত ৬ থেকে ৭ জন যুবকের একটি দল তাদের সঙ্গে মারাত্মক তর্কে জড়িয়ে পড়ে।
দলটি সেই মুহূর্তে পূজা বন্ধের দাবি জানাতে থাকে। প্রতিমাগুলো টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলতে চায়। মণ্ডপের শামিয়ানা টেনে নামাতে চায়। তারা স্লোগান দিতে থাকে: 'বন্ধ বন্ধ, পূজা বন্ধ', লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে'।
এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার জন্য উপস্থিত জনতাকে উস্কানি দেওয়ার পাশাপাশি ১১টার দিকে যুবকের দল মণ্ডপে পাথর ছুড়তে শুরু করে। এর মধ্যে মণ্ডপের দুই পাশে লোকজন বেড়ে যায়। সাড়ে ১১টার দিকে তারা মণ্ডপে ভাংচুর শুরু করে।
পরিস্থিতি সামলাতে এর কয়েক মিনিটের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স ডাকা হয়। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে জনাপঞ্চাশেক লোক আহত হয়। সে সময় ডিসি, এসপি ও মেয়র কাছের একটা বাড়িতে আশ্রয় নেন।
পুলিশ ও জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
ফেসবুক লাইভে আসা ফয়েজ ও পুলিশকে প্রথম ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা একরাম- দুই জনকেই সেদিন সকালে আটক করা হয়। তারা এখন কারাগারে আছেন।
এদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টার মধ্যে শহরতলির অন্তত ১০টি এলাকা থেকে আসা মিছিল কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত পূবালী চত্বরে সমবেত হয়। মিছিলকারীরা শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১৪টি পূজামণ্ডপের পাশাপাশি কালিঘাট তলা, চানময়ী কালিবাড়ি ও আনন্দময়ী মন্দিরে ভাঙচুর চালায়।
উপরে যে ঘটনাক্রম হাজির করা হয়েছে তার জন্য দ্য ডেইলি স্টার অন্তত ৫০ জন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে। দেখা হয়েছে ডজনখানেকের বেশি ভিডিও ক্লিপ।
কিছু ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, মিছিলগুলোর নেতৃত্বে থাকা লোকজনের মধ্যে বেশিরভাগ কিশোর বয়সী। চোখে পড়ে, ভয়ানক সব স্লোগান দিতে দিতে তারা মন্দির ও মণ্ডপ ভাঙচুর করছে।
কুমিল্লা শহর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাস টিটু বলেন, ১১টা থেকে শুরু হয়ে সহিংসতা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। এ বছর শহরে মোট পূজা মণ্ডপ ছিল ৯১টি।
হামলাকারীরা কারা?
যেখান থেকে সহিংসতার শুরু, সেই নানুয়া দীঘির পাড় এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, হামলাকারীরা বহিরাগত। যাদের বেশিরভাগ কিশোর বয়সী। তারা এসেছিল শহরতলীর মুরাদপুর, তেলিয়াঘোনা, কাশারিপট্টি, শুভপুর, টিক্কাচর এলাকাগুলো থেকে।
নানুয়া দীঘির পাড়ের নিকটবর্তী মজুমদার বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আমানত মজুমদার (৯০) ডেইলি স্টারকে জানান, স্থানীয়রা হামলাকারীদের আটকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি।
'কারণ তারা বন্যার মতো এসেছিল। আমাদের পাড়ায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এটা কখনোই আমাদের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। আমরা ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছি। আমার পুরো জীবনে কুমিল্লায় এমন কোনো ঘটনা ঘটতে দেখিনি,' বলেন এই বৃদ্ধ।
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা ইসলাম আহমেদের মতে, ইসলামের কথিত অবমাননা একজন হিন্দু করতে পারেন না।
তিনি বলেন, 'এটাকে (কথিত কোরআন অবমাননার অভিযোগ) পূর্ব পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। হয়তো সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য কিছু লোক এটা করেছে।'
১৯৯০ সালে থেকে নানুয়া দীঘির উত্তর পাড় মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
পূজার তৃতীয় দিন অষ্টমীর সকালে কী ঘটেছিল তা জানতে মণ্ডপ থেকে কয়েক গজ দূরে একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলেছে ডেইলি স্টার।
ওই তত্ত্বাবধায়ক বলেন, 'প্রতিদিন সকাল ৭টায় আমি ডিউটিতে আসি। এখানে এসে আমি দুই জন নারী ও দুই জন যুবককে দেখতে পাই। দুই যুবকের মধ্যে একজন কোতোয়ালি থানার ওসিকে ফোন করলে তিনি ২০ মিনিটের মধ্যে চলে আসেন। যেহেতু বাইরের লোকজনকে মণ্ডপের ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য পর্দা দেওয়া ছিল, তাই ভেতরে ঠিক কী হচ্ছিল, তা আমি দেখতে পাইনি।'
তার কাছ থেকে জানা যায়, ৭টার পর সেখানে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, একরাম হোসেন নামের যে ব্যক্তি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেছিলেন তিনি ঘটনাস্থল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের একটা এলাকায় বাস করেন। আর ফয়েজ আহমেদ ছিলেন প্রবাসী। এক বছর আগে তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে আসেন। এখন কুমিল্লা শহরে তার কাপড় ও মোবাইলের সরঞ্জামের দুইটি দোকান আছে।
একরামের মা সেলিনা আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করে গত ১২ অক্টোবর সে বাড়ি ছাড়ে। ১৩ অক্টোবর আমরা জানতে পারি যে, তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।'
মণ্ডপের তত্ত্বাবধায়ক জানান, পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাত আড়াইটার দিকে তিনি মণ্ডপ ত্যাগ করেন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তিনি ফোনে জানতে পারেন যে, কেউ গণেশের প্রতিমার নিচে পবিত্র কোরআন রেখেছে।
তিনি বলেন, 'আমি সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি পূজা কমিটির ঊর্ধ্বতনদের জানাই। মণ্ডপে পৌঁছে ওসিকে দুই যুবকের সঙ্গে কথা বলতে দেখি। দ্রুতই দীঘির পশ্চিম ও পূর্ব পাড়ে ভিড় জমে যায়।
'এলাকার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বন্ধন ও সম্প্রীতির পরিপ্রেক্ষিতে মণ্ডপে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়নি। আমরা কখনোই ভাবিনি যে অতিরিক্ত নিরাপত্তার দরকার হবে। কিছু লোক এর সুযোগ নিয়েছে।'
মেয়র দেরিতে এসেছিলেন
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য মেয়র মনিরুল ইসলাম সাক্কুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি সাধারণত ৮টায় ঘুম থেকে উঠি। সকাল ৭টায় ওসির একটা কল আমি রিসিভ করতে পারিনি।'
তিনি জানান, ৮টায় কল ব্যাক করলে ওসি তাকে ঘটনাস্থলে যেতে অনুরোধ করেন।
মেয়র বলেন, 'আমি বললাম আমার আসতে দেড় ঘণ্টা লাগবে। এর মধ্যে পূজা কমিটির কয়েকজন আমার বাড়িতে এসে ঘটনার বিস্তারিত জানায়। আমি তাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করি। আমি সেখানে পৌঁছাই সাড়ে ৯টার দিকে। সেখানে তখন এক থেকে দেড় শ লোক ছিল। আমি তাদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানাই। ডিসি ও এসপির উপস্থিতিতে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই।
'এক পর্যায়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করলে আমি সিটি করপোরেশন থেকে ৪০ জন কর্মী ডেকে মণ্ডপের ভেতরের বাকি জিনিসপত্র সরিয়ে নেই। সেখানে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। যদিও আমি পূজা কমিটিকে কিছু ক্যামেরা বসাতে বলেছিলাম।'
তার বাড়ি মণ্ডপের এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও তিনি এত দেরিতে কেন আসলেন- জানতে চাইলে মেয়র পরিষ্কার কোনো জবাব দিতে পারেননি।
'ঘুম থেকে উঠে আমি গোসল করেছি, কাপড় পরেছি। তারপর বাড়ির বাইরে বেরিয়েছি। সব মিলিয়ে সময় লেগেছে।'
পুলিশি অ্যাকশনে বিলম্ব
কোতোয়ালি থানার ওসি সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে একাই ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এসপি পৌঁছান প্রায় ১০টার দিকে। হামলা শুরু হয় ১১টায়। এর মধ্যে উত্তেজিত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তারা সংগঠিত হতে থাকে।
হামলার পর র্যাব ও অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের জন্য ৪ ঘণ্টা সময় কেন লাগলো- জানতে চাইলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাদের যথেষ্ট লোকবল ছিল।
এরপর তিনি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি।
কোতোয়ালি থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, অন্যদের আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা একরাম ও ফয়েজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'তারা কেন অত আগে সেখানে গিয়েছিল এবং ফেসবুক লাইভের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি।'
মণ্ডপের ভেতর থেকে লাইভ করার সময় বাধা দিলেন না কেন- জানতে চাইলে ওসি বলেন, 'তথ্য নেন, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করবেন না।'
হামলার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে চারটি ও র্যাবের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য, একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং বাকি দুটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে।
পুলিশ জানায়, ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত তারা মোট ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments