অস্থায়ী চা শ্রমিকদের সমান মজুরি এখনো অধরা
সারাদেশে বিশেষ করে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কয়েক হাজার অস্থায়ী চা শ্রমিককে মজুরি চুক্তি অনুযায়ী স্থায়ী শ্রমিকদের সমান দৈনিক মজুরি দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা পাচ্ছেন না। এমনকি অস্থায়ী চা শ্রমিকরা বিভিন্ন সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ তাদের।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন চুক্তি অনুযায়ী, স্থায়ী শ্রমিকরা বর্তমানে দৈনিক মজুরি হিসাবে ১২০ টাকা পাচ্ছেন, যা আগে ছিল ১০২ টাকা।
কিন্তু, অধিকাংশ অস্থায়ী চা শ্রমিক অজ্ঞাত কারণে আগে পেতেন ১০২ টাকা বা ১০০ টাকার নিচে।
চুক্তির পর স্থায়ী শ্রমিকরা নতুন মজুরি পেতে শুরু করলেও অস্থায়ী শ্রমিকরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সোনাছড়া চা বাগান ইউনিট সভাপতি কার্তিক নায়েক।
রাবার সেকশনের অস্থায়ী চা শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি পান ১০০ টাকা, যারা কীটনাশক দেন তারা পান ৮২-৮২ টাকা, যারা আগাছা পরিষ্কার করেন তারা পান ৭৫ টাকা এবং যারা পাতা তুলেছেন তারা পান ১০০ টাকা।
অস্থায়ী চা শ্রমিক কলোতি রবিদাস বলেন, 'আমি স্থায়ী চা শ্রমিকের মতো কাজ করলেও মজুরিসহ সুযোগ কম পাই। আমি যদি মজুরি বা অন্যান্য সুযোগ নিয়ে দর কষাকষি করি বা এক বা ২ দিনের জন্য কাজ এড়িয়ে যাই। আমার পরিবার সেই দিনগুলো অর্ধেক খেয়ে বা না খেয়েই পার করবে।'
আরেক অস্থায়ী চা শ্রমিক সাতরাম কৈরি বলেন, 'ভাষার সমস্যার কারণে চা বাগানের বাইরে কাজে যেতে পারি না। কর্মস্থলে চা বাগানের বাইরের লোকজন নানা ধরনের অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করে। সেজন্য আমরা বাইরে যাই না। এ কারণে কম মজুরি পেলেও আমরা চা বাগানে কাজ করে যাচ্ছি।'
ফুলছড়া চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি জগবন্ধু রায় বলেন, 'অস্থায়ী চা শ্রমিকদের স্থায়ী শ্রমিকদের সমান বেতন না দেওয়া নিয়ে আমরা অনেক প্রতিবাদ করেছি, বিভিন্ন সময় ধর্মঘট করলেও কাজ হয়নি।'
বালিশিরা ভ্যালি ইউনিটের বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, 'মালিক অস্থায়ী চা শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক বলছেন। আমরা তা মানি না। আমরা বারবার মালিককে বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সমান মজুরি এখনো অধরা।'
শ্রম উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ চা সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে বিটিএ সচিবের সঙ্গে কথা বলা ভালো।'
অস্থায়ী চা শ্রমিক, সবিতা ঘাটুয়াল বলেন, 'আমরা স্থায়ী শ্রমিকের মতো একই রকম কাজ করি। তবে, সরকারি অনুদান এবং অন্যান্য সুযোগ সবসময় স্থায়ীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। আমরা প্রতিটি সুযোগ থেকে উপেক্ষিত।'
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল জানান, বেশিরভাগ সুবিধা স্থায়ী শ্রমিকদের দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, 'গত ২০১৫-১৬ সালের চুক্তি থেকে স্থায়ী ও অস্থায়ী চা শ্রমিকরা সমান মজুরি পাবেন বলে বলা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।'
তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ চা বাগানে অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী চা শ্রমিকের সমান মজুরি দেওয়া হলেও শ্রীমঙ্গলে এর ভিন্নতা আছে। কিছু কিছু চা বাগানে এটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না।'
সমাজসেবা (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া) অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান স্থায়ী চা শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'আমরা পরের বার ব্যবস্থা নেব।'
স্ট্যটিসটিকেল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইনডাসট্রি-২০১৯-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৬টি চা বাগান আছে। যেখানে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক আছেন।
মোট চা জনসংখ্যা, অর্থাৎ যারা স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, 'সরকারিভাবে চা বাগানে অস্থায়ী চা শ্রমিকের সংখ্যা ৩৬ হাজার দেখানো হলেও এখন তা ৫০ হাজারের বেশি হবে।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশিও চা সংসদ অস্থায়ী চা শ্রমিকদের সমান মজুরি দেওয়ার জন্য মজুরি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, কিন্তু শ্রীমঙ্গলের কিছু চা বাগানে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে আমরা আলোচনা অব্যাহত রেখেছি।'
বাংলাদেশিও চা সংসদের চেয়ারম্যান এম শাহ আলম বলেন, 'আমরা আশাকরি বিটিএ সদস্যরা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছি তা বাস্তবায়ন করবেন। এটি আমাদের সুপারিশ।'
Comments