আবারও তুরাগ ভরাট করছে বিআইডব্লিউটিএ

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ভারী জেটি নির্মাণের নামে তুরাগ নদ ভরাট করে রাজধানীর গাবতলী, আমিনবাজার ও দিয়াবাড়িতে আবারও স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।
২০০৫ সালে গাবতলী, আমিনবাজার ও দিয়াবাড়িতে তুরাগ নদ ভরাট করে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিসের জন্য ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ করেছিল বিআইডব্লিউটিএ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ৩টি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের পর থেকে স্টেশনগুলোর দুই পাশে অবৈধভাবে নদী ভরাট করা হয়েছে। কোথাও সরকারিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ভবন। বর্তমানে ভারী জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে ইতোপূর্বে নির্মাণ করা ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোর আশপাশে।
পরিবেশবাদীদের মতে, নদী ভরাট করে ভবন নির্মাণের মাধ্যমে তুরাগ নদ বিষয়ে হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করা হয়েছে। তারা নদী থেকে বিআইডব্লিউটিএসহ সব সরকারি ভবন অপসারণের দাবি জানান।
রাজধানী ঢাকার ৪ দিকের নৌপথে 'ওয়াটার ট্যাক্সি' চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল প্রায় দেড় যুগ আগে। মূলত ওয়াটার ট্যাক্সির যাত্রীদের উঠা-নামার জন্য ২০০৫ সালে বিআইডব্লিটিএ তুরাগ নদ ভরাট করে গাবতলী, আমিনবাজার ও দিয়াবাড়িতে 'ল্যান্ডিং স্টেশন' নির্মাণ করে।
বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়ে ওয়াটার ট্যক্সি বা ওয়াটার বাস চালুর সরকারি প্রকল্প ব্যর্থ হয়। ওয়াটার বাস চলাচল বন্ধ আছে দীর্ঘদিন ধরেই। ফলে প্রায় অব্যবহৃত হয়ে আছে নদী ভরাট করে নির্মাণ করা ল্যান্ডিং স্টেশন ভবনগুলো।
দিয়াবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তুরাগ নদী পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে নদীর সীমানা পিলারের দেড় শতাধিক ফুট ভেতরে ২০০৫ সালে নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছিল ল্যান্ডিং স্টেশন। দিয়াবাড়ি ল্যান্ডিং স্টেশনের পাশেই নদী ভরাট করে গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ল্যান্ডিং স্টেশনের দুই পাশেই নদী ভরাট অব্যাহত রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ। এরমধ্যে ল্যান্ডিং স্টেশনের দক্ষিণ দিকে নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে ভারী জেটি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর যৌথ উদ্যোগে স্থাপন করা ২১০, ২১১, ২১২ নম্বর ছোট দিয়াবাড়ি সীমানা পিলারের প্রায় ১০০ ফুট ভেতরে জেটিটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, দিয়াবাড়ি ল্যান্ডিং স্টেশনের উত্তর দিকেও নদী ভরাট করা শুরু করেছে বিআইডব্লিউটিএ। ল্যান্ডিং স্টেশনের উত্তর দিকেও নদী ভরাট করে সেখানে ইকোপার্ক স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যেই সেখানে সাইনবোর্ড টানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
আমিনবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হচ্ছে আমিনবাজার ভারী জেটি। আমিনবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনটি সীমানা পিলারের দেড় শতাধিক ফুট ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে আমিনবাজার জেটিটি নির্মাণ করা হচ্ছে দেশী সীমানা পিলার ১০৯, ১১০ ও ১১১ নম্বর ভেতরে। এরমধ্যে জেটি ভবনটি ১০৯ নম্বর সীমানা পিলার থেকে প্রায় ৪০ ফুট এবং ১১০ নম্বর সীমানা পিলার থেকে প্রায় শতাধিক ফুট ভেতরে।
আরও দেখা যায়, ল্যান্ডিং স্টেশন ও নির্মাণাধীন ভবণের মাঝে প্রায় সাড়ে ৩০০ ফুট স্থানও মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে।
গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশনটি নদীর বর্তমান সীমানা পিলার থেকে প্রায় ১৫০ ফুট ভেতরে। গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশনের উত্তর দিকে নির্মাণ করা হচ্ছে গাবতলী ভারী জেটি।
গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশন ও নির্মাণাধীন গাবতলী ভারী জেটির মধ্যে নদী ভরাট করে ইতোমধ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি দোতলা সরকারি ভবন। গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশনের নির্মাণের পর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর 'সেন্ট্রাল মার্কেট গাবতলী' নামে ভবনটি তৈরি করে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান ড. আবু নাসের খান তুরাগ নদে ভারী জেটি নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, 'এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। নদীর প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ না করতে হাইকোর্টের রায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের পর দুই পাশে ক্রমশ ভরাট হতে থাকে। দুই পাশে অবৈধভাবে দখল চলতে থাকে।'
ড. আবু নাসের খান আরও বলেন, 'জেটি নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সেটা নদী ভরাট করে নয়। সড়ক পথে দেখা যায়, ৫/১০ কিলোমিটার পর পর পার্কিং স্থান থাকে। সেখানে সড়ককে পাশে বর্ধিত করা হয়। নদীতেও এভাবে করা যেতে পারে। সেখানে জেটি নির্মাণ করা হবে, সেখানে নদীকে খনন করে রাস্থার পাশে নিয়ে যেয়ে তারপর জেটি নির্মাণ করা দরকার।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হাইকোর্টের রায়ে নদীর সীমানা চিহ্নিত করা, সীমানা পিলার স্থাপন, ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং নদীর সীমানা পিলারের ভেতরে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তুরাগ নদের সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে না।
শরীফ জামিল আরও বলেন, নদীর ১০০ থেকে ১৫০ ফুট ভেতরে ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ভবনের পেছনের ও দুপাশের নদীর জায়গায় অবৈধ দখলকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। তুরাগ নদীতে ল্যান্ডিং স্টেশন, ভারী জেটি ইত্যাদি নির্মাণ প্রকল্প নদীর স্বার্থে নেয়া হচ্ছে না। মানুষের স্বার্থে নেয়া হচ্ছে না। নেয়া হচ্ছে গোষ্ঠী স্বার্থে, ব্যক্তি স্বার্থে। যারা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাদের দুদকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ব্যক্তিস্বার্থ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
তুরাগ নদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঢাকার সার্কুলার ওয়াটারওয়ে প্রকল্পের উপপ্রধান পরিচালক মো. মতিউল ইসলামের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করার পরিবেশবাদীদের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
মো. মতিউল ইসলামের মতে, হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনেই তুরাগ নদের গাবতলী, আমিনবাজার ও সিন্নিরটেকে ভারী জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ে পণ্য পরিবহনের জন্য জেটি ও চলাচলের জন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
Comments