‘আমি মনে করি, এই বইমেলাটা আমরা এক মাস চালাতে পারি’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অমর একুশে বইমেলা ২০২২ এর উদ্বোধন করেন। ছবি: পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চ পর্যন্ত অমর একুশে বই মেলার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে বাংলা একাডেমি, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'অতীতে দেশের প্রত্যেক জেলা বা মহকুমায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সাহিত্য চর্চা হতো, সাহিত্য সম্মেলন হতো, আলোচনা হতো সে চর্চাটা অনেকটা কমে গেছে। এটাকে আবার একটু চালু করা দরকার।'

প্রধানমন্ত্রী আজ মঙ্গলবার বিকেলে অমর একুশের বইমেলা উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের প্রত্যেকটি জেলার পাশাপাশি এখন উপজেলা পর্যায়েও শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এবং আমাদের এই বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও আপনারা যদি একটু উদ্যোগ নেন তাহলে আপনারা দেখবেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মেধাবী কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী আমরা পাব।

তিনি বলেন, এতে তাদের জ্ঞান ও মেধা বিকাশের যেমন সুযোগ আসবে তেমনি মানুষের হৃদয়ের খোরাকটাওতো দরকার। খাদ্য নিরাপত্তা আমরা করে দিয়েছি এখন হৃদয়ের খোরাকটা জোগাতে হবে। আর তা সংস্কৃতিসেবীদের মধ্য থেকেই আসে।

শেখ হাসিনা বলেন, সংস্কৃতিক জগৎ বা আমাদের শিল্প সাহিত্য জগৎ বা এই ধরনের মেলা যদি হয় বা অনুষ্ঠানগুলো যদি হয় তাহলে কিন্তু আমাদের যারা যুব সমাজ রয়েছে তারাও ভিন্ন পথে যাবে না। তারা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রতিও আন্তরিক থাকবে।

জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের উদ্যোগ নেয়ারও প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেন তিনি।

অতীতে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে একমাস ব্যাপী বই মেলার আয়োজন করা হলেও এবার করোনা পরিস্থিতির জন্য মেলা একটু দেরিতে শুরুর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যেহেতু আমরা এক মাসের জন্য করতাম কিন্তু আমরা এবার দেরিতে শুরু করেছি, আজকে ১৫ তারিখ। তাই, এটা মনে হয় আমরা পুরো মাসই চালাতে পারি। যেহেতু আমাদের প্রকাশকদের পক্ষ থেকেও একটা দাবি এসেছে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ পর্যন্ত এটা চলতে পারে।

আমি মনে করি যে, এই বই মেলাটা আমরা এক মাস চালাতে পারি। তবে, সেটা আপনারা নিজেরাও ভেবে দেখবেন কারণ, আমি একাতো আর কিছু বলতে পারবো না। আর এই বই মেলাটা শুধু বইমেলা নয় সকলের মিলন মেলা, বলেন তিনি।

করোনার কারণে এবারের বই মেলায় আসতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী তার শিক্ষা জীবনে দিনভর বই মেলায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি স্মরণ করেন।

তিনি বলেন, বিরোধী দলে থাকার সময়ও তিনি বই মেলাতে গিয়েছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নিরাপত্তা অজুহাতে পায়ে 'শেকল পরা'তে তা আর সম্ভব হয়নি।

তিনি করোনাকালীন অনেক আপনজন এবং শ্রদ্ধাভাজনকে হারানোয় দুঃখ প্রকাশ করে এই পরিস্থিতির অচিরেই উত্তরণ হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তবে, এখন যারা বই মেলায় আসবেন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, 'এটা একান্তভাবে দরকার।'

সরকারের টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আর আমরা  ইতোমধ্যে টিকা দিচ্ছি। বুস্টার ডোজও দেয়া হচ্ছে। যারা নেন নাই অবশ্যই তাদেরকে টিকা এবং বুস্টার ডোজটা নিয়ে নিতে হবে।

তিনি বলেন, যাদের এখনো টিকা নেয়া হয়নি তারা সবাই কিন্তু টিকাটা নেবেন। অন্তত টিকাটা নেওয়া থাকলে আপনি একটু সুরক্ষিত থাকবেন। এই কথাটা সবাইকে একটু মনে রাখতে হবে। আর একটু মাস্কটা পড়ে থাকলেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায়।  

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২১ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে বিশষ অতিথি হিসেবে ১৫ জন বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

পুরস্কার বিজয়ী প্রত্যেক ৩ লাখ টাকার চেক এবং ক্রেস্ট লাভ করেন।

বাংলা একাডেমির সভাপতি কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর। আরো বক্তৃতা করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন।

শুরুতে জাতীয় সঙ্গীতের পরই অমর একুশের গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি' পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

এরপরই ভাষা শাহীদদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিটি নিরবতা পালন করেন।

বিদেশি ভাষা-সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি নিজেদের অস্তিত্ব আরো বড় করে তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, বিদেশি ভাষা শেখায় আপত্তি নেই, বিদেশি ভাষাও শেখা দরকার। সেখানকার সংস্কৃতি চর্চাও জানা দরকার। কিন্তু নিজের যে অস্তিত্ব সেটাকে আরো বড় করে আমাদের দেখাতে হবে। আরো উন্নত মানের করতে হবে।

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব এবং এই দেশ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই গড়ে উঠবে। সেটাই আমাদের অঙ্গীকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা শহীদদের অবদান আমরা কোনদিনও ভুলতে পারবো না। কেননা, এই ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার মধ্যদিয়েই একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের প্রথমার্ধ থেকেই ভাষার জন্য যে আন্দোলনের সূচনা হয় তাতে গোড়া থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে 'সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' এবং জাতির পিতার রচিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে তার ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণের বিভিন্ন খন্ড চিত্র তুলে ধরেন।

অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে এবং আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের অবদানের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আজকে আমরা জাতির পিতা জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। সেই সাথে সাথে মাতৃভাষায় কথা বলার যে সুযোগটা পেয়েছি তা আমাদের ধরে রাখতে হবে। অনেক বাধা এসেছে আঘাত এসেছে তা মোকাবিলা করেই বাংলাদেশ আজকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

একটি জাতিকে রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার পাইয়ে দেয়ার জন্যই জাতির পিতা আজন্ম সংগ্রাম করে গেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী অনুবাদ সাহিত্যে জোর দেয়ার জন্যও সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, কেবল নিজের ভাষায় সাহিত্য চর্চা করলেই হবে না, আমাদের আন্তর্জাতিক ভাষা সম্পর্কেও জানতে হবে। কাজেই অনুবাদ আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ, অন্য দেশের এবং অন্য ভাষা-ভাষীদের সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের যেমন জানা দরকার তেমনি আমাদের ভাষা-সাহিত্যও যেন অন্য দেশ এবং ভাষাভাষীরা জানতে পারে সে সুযোগটা আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। আর এজন্য বাংলা একাডেমি কাজ করে যাচ্ছে। সেজন্য বাংলা একাডেমিকে অন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

সরকার প্রধান বলেন, মুজিববর্ষ উদযাপনের চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলা একাডেমি 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ গ্রন্থমালা' প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে ৪০টিরও অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজেও অনেক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন উল্লেখ করে এই ধারা অব্যাহত রাখারও আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, আমি মনে করি যে এই বইমেলায় যে সমস্ত বই প্রকাশনা হবে সেগুলোও আমাদের সাহিত্য জগতে বিরাট অবদান রাখবে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ভাষা সাহিত্য আরো ব্যাপক পরিচর্যা যাতে হয় তার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি অর্থাৎ অনলাইনে বাংলা ব্যবহারের জন্য আমরা নানা ধরনের বাংলা অ্যাপসও চালু করেছি।

অভিন্ন বাংলা ফন্ট ব্যবহারে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ভিন্ন ভিন্ন ফন্ট আছে সেটা একটা অভিন্ন ফন্ট যাতে ব্যবহার হয় যাতে খুব সহজে সকলে কম্পিউটারের মাধ্যমে বা অনলাইনে ভাষা ব্যবহার করতে পারেন সেইভাবে একটা প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

কাজেই, ডিজিটাল প্রকাশনাও আমাদের সাথে সাথে করতে হবে। আধুনিক এই চর্চাটা যেন বাদ না যায় সেটা দেখার জন্যও সংশ্লিষ্ট মহলকে পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।  

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

2h ago