‘কোথাও যেতে চাইলে সে আমাকে পিঠে করে নিয়ে যায়’

একদিন বিকেলে অফিস ছুটির পর টেবিলের ড্রয়ার থেকে ১০ টাকার নোট বের করে নোটের ওপর একটি মোবাইল নম্বর দেখে সেই নম্বরে ফোন দেন সোহেল মিয়া। সেখান থেকে রওশন আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় সোহেলের। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তারা একে অপরের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে প্রেমে পড়েন। এরপর সে বছরের ডিসেম্বরে বিয়ে।
তবে, তাদের প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ের বিষয়টা আর দশজন মানুষের থেকে আলাদা। সোহেল এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এই চলার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। তার কারণ, জন্ম থেকেই আমার স্ত্রী রওশনের দুই পা অচল। পায়ে ভর দিয়ে চলার শক্তিটুকুও নেই। আমার পিঠে চড়ে এখানে-ওখানে চলাচল করতে হয়।'

ভবিষ্যতে নানা ধরনের সমস্যা আসতে পারে জেনেও পরিবারের সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করতে হয়েছিল ময়মনসিংহের ত্রিশালের রওশন আক্তার ও রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সোহেল মিয়ার।
আট ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সোহেল। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে ভাই-বোনের আশ্রয়ে থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো একটা চাকরিও শুরু করেন সোহেল।
বিয়ের পর রওশন অন্তঃসত্ত্বা হলে একেবারে নড়াচড়া করতে পারতেন না। তাকে সহযোগিতার জন্য এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে অভাবের সংসার বেছে নেন সোহেল। সব অভাব-অনটনকে ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন এ দম্পতি। এক সময় তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যাশিশু।
রওশন আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি প্রতিবন্ধী হওয়ায় আমার পরিবারও বিয়েতে সম্মত ছিল না। সে সময় সবাই বলাবলি করেছে, বিয়ের পর আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি যাকে ভালোবাসবো সেও আমাকে ভালোবাসবে। এই বিশ্বাসটাই আমি সোহেলের ওপর করতে পেরেছিলাম। এ কারণে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার হাত ধরে আমি পালিয়ে যাই এবং বিয়ে করি। মেয়ে হওয়ার পর আমাদের ভালোবাসা ও দায়িত্ব আরও বেড়েছে।'
রওশন আরও বলেন, 'কোথাও যেতে চাইলে সে আমাকে তার পিঠে তুলে নিয়ে যাওয়া-আসা করে। আমার চাহিদা পূরণের জন্য সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে।'
গত ১৭ মাস আগে স্ট্রোক করে সোহেল এখনো অসুস্থ উল্লেখ করে রওশন বলেন, 'পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়ের খরচ চালানোও কঠিন হয়ে পড়েছে।
ত্রিশালের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামে ছোট্ট মাটির ঘর আর একটি টং দোকানই এখন তাদের সম্বল। তার হুইল চেয়ারটি নষ্ট হয়ে গেলেও অভাবের কারণে কিনতে পারছেন না বলে জানান রওশন।
শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম হলেও তার ভেতরে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই উল্লেখ করে সোহেল বলেন, 'শারীরিকভাবে স্বাভাবিক একজন মেয়ের চেয়ে সে বেশি কিছু করার চেষ্টা করে।'
সোহেলের কাছে ভালোবাসা অর্থ, একজনের কাছে আরেকজনের দায়বদ্ধতা, সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থাকা। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। তিনি বলেন, রওশনকে যেভাবে অন্ধের মতো ভালোবেসেছি, তার মাঝেও তেমনই দেখেছি।
সোহেলের প্রেম, ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাসই তার কঠিন জীবন সংগ্রামের একমাত্র ভরসা বলে জানান রওশন।
সোহেল-রওশনের এমন ভালোবাসার বন্ধন দেখে মুগ্ধ স্বজন ও প্রতিবেশীরা। সত্যিকারের ভালোবাসা যে কতটা গভীর, তা তাদের দেখেই বুঝতে পারি, বলেন তারা। রওশনকে পিঠে নিয়ে সোহেল যেভাবে আনা-নেওয়া করে তা সত্যিই শ্রদ্ধা আর ভালো লাগার মতো।
Comments