চলে গেলেন বাংলাদেশের বন্ধু সাইমন ড্রিং

সাইমন ড্রিং। ছবি: ফ্রেন্ডস অব ৭১-এর ডকুমেন্টারি থেকে নেওয়া

শুক্রবার না ফেরার দেশে চলে গেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বিদেশি বন্ধু সাইমন ড্রিং। যে কজন বিদেশি সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু হিসেবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধকালীন ভয়াবহতার কথা তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে সাইমন ড্রিংয়ের নাম।

প্রবাদপ্রতিম এই সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৯৭১ সালে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার ছিলেন সাইমন ড্রিং। তখন তিনি সংবাদ পাঠাচ্ছিলেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে। হঠাৎ একদিন লন্ডনের হেড কোয়ার্টার থেকে ফোন করে তাকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা চলে যাও।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় দ্যা টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত সাইমন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন

সাইমন ড্রিং অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করেছেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। তাও তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় এলেন। পরদিন ৭ মার্চ ছিল রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা। সেই ঐতিহাসিক দিনের তিনি ফুটেজও নিয়েছিলেন। অথচ পুরো ভাষণের কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া, তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে অনুভব করলেন, এক বিশাল মোড় নিচ্ছে একটি দেশ ইতিহাসের মহাকালে।

সাইমন ড্রিং পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সেদিন মানুষের উদ্দীপ্ত চোখ যেন একেকটা বারুদ। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ইতিহাসের নতুন মোড় নিচ্ছে।’

রাজনৈতিক নেতা ও জনসাধারণের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলে বুঝতে পারলেন এই দেশ আজীবন কেবল শাসিত হয়েই আছে। এরা আজীবন অত্যাচারিত হয়েই আছে। তিনি বুঝতে পারলেন এই অসহায় মানুষেরা এখনও এক জনের আঙ্গুলের ইশারায় স্বপ্ন বুনছেন নতুন করে। ভয়ংকর এক ঝড় চলছে মানুষের মনে।  সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসেছিলেন সাইমন ড্রিং, কিন্তু আর ফিরে যেতে পারলেন না।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাইমন ড্রিং

পাকিস্তানের রাজনীতি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম সম্পর্কে তার জানাশোনার পরিধি বাড়ল। বেশ কিছু বই পড়লেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতার সঙ্গে তার পরিচয় হলো, সখ্য গড়ে উঠলো। তিনি বারেবারে জনগণের মতামত জানার চেষ্টা করলেন। নিয়মিত লন্ডনে রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে রিপোর্ট পাঠাতেন তিনি।

২৫শে মার্চ রাতে সাইমন ড্রিং ছিলেন ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। পাকিস্তানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে ২৭শে মার্চ ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন বিখ্যাত ডেইলি টেলিগ্রাফে। ৩০ মার্চ এটি প্রকাশিত হয়।

রিপোর্টটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পৃথিবীজুড়ে বিশাল জনমত সৃষ্টি হয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় ২০০ বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে ফেলে।

সকল সাংবাদিককে হোটেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয় যাতে করে বিশ্ব গণমাধ্যমের জন্য গণহত্যার কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারে। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক আইন অমান্য করে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে লুকিয়ে থাকেন। তার  শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘণ্টা সময় কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার, কিচেন প্রভৃতি স্থানে। পরে তিনি ঘুরে ঘুরে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন গণহত্যার বাস্তব চিত্র।

২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে সাইমন ড্রিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীর সঙ্গে সাইমন ড্রিং। ছবি সূত্র- দ্য ডেইলি স্টার

পরে অবশ্য  মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। কিন্তু তাকে এয়ারপোর্টে নাজেহাল করা হয়। উলঙ্গ করে চেক করা হয় সঙ্গে কী নিয়ে যাচ্ছেন! তার ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। পায়ের মোজায় কাগজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। এরপর তার পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে তাকে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, পাকিস্তান গেলে তিনি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন না।

এর কদিন পরেই পাকিস্তান সরকার তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। যদিও তিনি কলকাতায় এসে সেখান থেকে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন পাঠাতেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সঙ্গে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।

সাইমন ড্রিং কেবল সাংবাদিকতার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দাতব্য তহবিল দ্যা রেস এসেইন্ট টাইম তার হাতেই গড়া। যেখানে ১৬০টি দেশের সাড়ে ৫ কোটিরও বেশি লোক স্বেচ্ছায় অর্থ দিয়েছেন। ‘স্পোর্ট এইড’ নামের আরেকটি তহবিল ছিল। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ এ তহবিলে দান করেছিলেন, যা ব্যয় করা হয়েছিল আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য।

একসময় বিবিসিতে যুক্ত হয়েছিলেন সাইমন ড্রিং।  বিবিসিতে কর্মরত বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি। আশির দশকের শুরুর দিকে  বিবিসি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে সিনেমা প্রযোজনার জন্য কোম্পানি করেছিলেন। সেখান থেকে বিবিসি ও পাবলিক ব্রডকাস্ট সার্ভিসের জন্য নির্মাণ করেছিলেন বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও লাতিন আমেরিকার উপর সাইমন ড্রিং বহু অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। এসব প্রামাণ্যচিত্র বা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, পরিচালক ও প্রযোজনায় ছিলেন সাইমন ড্রিং নিজেই।

জীবনের বহু পথ অতিক্রম করেও বাংলাদেশকে ভুলতে পারেননি সাইমন ড্রিং। ভুলতে পারেননি এদের মানুষ, জল-বাতাসকে। সাইমন ড্রিং আবার ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে  বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি পর্যায়ের টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে  যুক্ত হলেন  সাইমন ড্রিং। তাকে বলা হয় বাংলাদেশে ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার জনক। 

অথচ আমাদের এই পরম বন্ধুকে আমরা অপমান করেছি। মুক্তিযুদ্ধের এই পরম বন্ধুকে আমরা ২০০২ সালে এক রাতের মধ্যেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছি। ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশনের বিরুদ্ধে  সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনজনিত কল্পিত অভিযোগ এনে তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়। সে বছর  ৩০শে সেপ্টেম্বর   সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ছাড়ার আদেশ দেন। মাত্র এক রাতেই চরম অপমানের শিকার হয়ে তিনি বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তবুও সায়মন ড্রিং এদেশের মায়া ভোলেননি। এরপরেও বেশ কবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। যে মানুষ, যে বাতাস, যে দেশকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছেন সাইমন ড্রিং সেই দেশকে তিনি কি করে ভুলতে পারেন!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু কিংবদন্তি সাংবাদিক ও লেখক সাইমন ড্রিং আজ  চলে গেলেন। এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের মনঃপ্রাণে, বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আপনার নাম। আপনি আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে থাকবেন সাইমন ড্রিং।

বিদায় বন্ধু। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আপনার প্রতি। 

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago