‘জিয়াউল হক জিয়ার ওপর শক্ত নজরদারি রাখা সম্ভব হয়নি’

অভিজিৎ রায়ের খুনের দায়ে অভিযুক্ত সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত জঙ্গিনেতা সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন, জিয়ার প্রতি আমাদের নজরদারি রয়েছে। আমরা তাকে ফলো করছি। যে কোনো সময় হয়ত আমাদের নেটওয়ার্কে এসে পড়বে।
গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলেছেন জিয়া বিদেশে পালিয়েছেন।
জিয়াউল হক জিয়া ২০১৭ সালের দিকে আসলে কেমন নজরদারিতে ছিলেন এবং তিনি কীভাবে দেশ থেকে পালালেন এসব বিষয় জানতে দ্য ডেইলি স্টার যোগাযোগ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্রিমিনোলোজি বিভাগের চেয়ারপার্সন খন্দকার ফারজানা রহমান এবং পুলিশের সাবেক অতিরিক্তি আইজিপি মোকলেসুর রহমানের সঙ্গে।
খন্দকার ফারজানা রহমান বলেছেন সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার ওপর যেভাবে নজরদারি রাখা দরকার ছিল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সেভাবে তা রাখতে পারেনি। অন্যদিকে মোকলেসুর রহমান বলেছেন জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করতে পারে।
ফারজানা রহমান বলেন, 'যখন কোনো অপরাধ ঘটে তখন সেই অপরাধী কোথায় থাকেন পুলিশ তার সোর্সের মাধ্যমে তা ট্রেস করেন। আবার অনেক সময় সেন্ট্রাল সিসিটিভির মাধ্যমে কাউকে ট্রেস করা যায়। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছে সেগুলো ব্যবহার করে কাউকে ট্রেস করা হয়। নজরদারি মানে হলো অপরাধী তাদের আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকা।'
তিনি বলেন, 'কেউ যখন তার পরিচয় গোপন করে বা ফোন নম্বর পরিবর্তন করে বা ভ্রমণের সময় পাসপোর্ট পরিবর্তন করে সেক্ষেত্রে নজরদারি রাখা সম্ভব হয় না। আমার মনে হয় না জিয়াউল হককে সম্পূর্ণ নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয়েছে। তার ওপর আমাদের শক্ত নজরদারি নেই।'
এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, 'অপরাধীর তুলনায় পুলিশের সংখ্যা অনেক কম তাই নজরদারি করা কঠিন। জিয়াউল হকের গতিবিধি, চলাচল, আর্থিক লেনদেন বা তিনি কোথায় থাকছেন তা যথাযথভাবে মনিটরিং করা উচিত ছিল। ২০১৭ সালে যদি তিনি সত্যিই নজরদারির মধ্যে থেকে থাকতেন তাকে অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে নজরদারির মধ্যে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু আমি মনে করি তাকে শক্ত নজরদারিতে রাখা যায়নি। একই সঙ্গে আমি বিশ্বাস করি নজরদারিতে রাখা অনেক কঠিন। কারণ অপরাধীদের নেটওয়ার্ক অনেক শক্ত। তবে আমাদের দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তাকে নজরদারিতে রাখার মতো সক্ষমতা ছিল।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, 'মন্ত্রী উনার কথা বলেছেন। কিন্তু অনেক ব্যক্তিগত বা গোপনীয় তথ্য থাকে যেগুলো সরকার ইচ্ছে করলেই বা সরকারের মন্ত্রীরা চাইলেই জনগণ বা মিডিয়ার সামনে শেয়ার করতে পারেন না। মন্ত্রী কোন সেন্সে নজরদারির কথা বলেছেন সেটি আমার কাছে পরিষ্কার না। একজন ব্যক্তি চুল দাড়ি ফেলে দিলে বা রাখলে তার চেহারার পরিবর্তন হতে পারে। আমাদের দেশে ঘুষ বা অন্য কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা খুবই সহজ। অনেক সময় ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমেও অপরাধীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জিয়াউল হকের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে। এভাবে হয়তো তিনি নজরদারির বাইরে চলে গেছেন।'
যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার ঘোষণা বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে মনে হয় জিয়াউল হকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তদন্ত করে প্রমাণে পেয়েছেন যে তিনি বড় ধরনের কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাই যুক্তরাষ্ট্র তার বিচার করতে চায়। তা নাহলে এতো বড় পুরস্কার কখনেই ঘোষণা করা হতো না।'
'যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র একটা বড় পুরস্কার ঘোষণা করেছে তাই আমারে কাছে মনে হয় জিয়াউল হকের নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য বাংলাদেশের পুলিশের কাছে নেই। এতো বড় পুরস্কার ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই বাংলাদেশের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বা তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে। সম্ভবত, বাংলাদেশের পুলিশ কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না দিতে পারায় যুক্তরাষ্ট্র এই পুরস্কার ঘোষণা করেছে।'
সাবেক অতিরিক্তি আইজিপি মোকলেসুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন নজরদারির কথা বলেছিলেন তখন অবশ্যই তথ্যের ভিত্তিতেই বলেছিলেন। একজন মানুষ যখন অপরাধ করেন তখন তিনি নানাভাবে পালানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময় চাঞ্চল্যকর হত্যার আসামি ধরতে সময় লাগে। এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। জঙ্গিদের পৃথিবীতে বড় ধরনের একটা নেটওয়ার্ক আছে। তারাও তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেত পারে।'
তিনি বলেন, 'এখন পুলিশের সবচেয়ে বড় কাজ হলো সে কোথায় আছে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা। পুলিশের কোনো কোনো জায়গায় ব্যত্যয় হতে পারে। তবে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।'
যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার ঘোষণা বিষয়ে তিনি বলেন, 'তারা কোন আঙ্গিকে পুরস্কারের কথা বলেছে তা কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে বুঝতে হবে। জিয়াউল হক বাংলাদেশে আছেন এ ধরেনের তথ্য যুক্তরাষ্ট্র কোথায় পায়, কে তাদের তথ্য দিয়েছে তা জানতে হবে। কোথাও না কোথাও তথ্যের গরমিল আছে। আমরা মনে করি এই পুরস্কার জিয়াউল হককে ধরতে সাহায্য করবে এবং তাকে ধরতে পারলে আমাদেরও অনেকখানি মুখ রক্ষা হয়। তাকে ধরে আইনের আওতায় আনা পুলিশের জন্য জরুরি কাজ। জিয়াউল হককে ধরতে পুলিশকে আরও জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং অনেক অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। পুলিশের যত কৌশল আছে তা প্রয়োগ করতে হবে।'
Comments