নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নে কোনো অজুহাত থাকতে পারে না

দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার। এ ছাড়া, তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সেক্রেটারি। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইরেশ ওমর জামাল’র সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের উদাসীনতা নিয়ে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার। এ ছাড়া, তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সেক্রেটারি। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইরেশ ওমর জামাল'র সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের উদাসীনতা নিয়ে।

দ্য ডেইলি স্টার: সংবিধানে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ থাকলেও আমরা কেন এখনো পর্যন্ত তা করতে পারিনি?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: কারণ, সহজ কথায় বলতে গেলে আমাদের রাজনীতিবিদরা চাননি কোনো আইন থাকুক। আইন থাকা মানে একটা প্রক্রিয়া, কিছু সীমাবদ্ধতা ও কিছু নির্দেশনা ঠিক করে দেওয়া। ফলে আপনি যা খুশি তা করতে পারবেন না। যদিও আইনের ফাঁকফোকর থাকে এবং উদ্দেশ্য সৎ না হলে আপনি সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু, একটি আইন আপনার হাতকে কিছুটা হলেও বেঁধে রাখতে পারে এবং আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা চাননি। তারা যা খুশি তাই করতে, যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়োগ দিতে চেয়েছেন।

ডেইলি স্টার: সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি এ ধরনের একটি আইনের প্রয়োজন কেন? এটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে কীভাবে উন্নত করবে?

বদিউল আলম: আমি আগেই বলেছি, আইন একটা গণ্ডী নির্ধারণ করে দেয়, একটা দিকনির্দেশনা ও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ঠিক করে দেয়। যেমন, ইসিতে যোগ্য ও নির্দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া হলে হয়তো তারা স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারবেন। এতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না তবে, অবশ্যই সম্ভাবনা বাড়বে। জনগণের স্বার্থেই আমাদের অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। যাতে গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এতে, দায়িত্বপ্রাপ্তরা জনগণের কাছে অনেক বেশি দায়বদ্ধ থাকেন।

আমি কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা বা প্রক্রিয়ার কথা বলছি? দেখুন, আইনে ইসির বিভিন্ন পদের প্রার্থীদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার বিষয়গুলো উল্লেখ থাকতে পারে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি ও পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর যদি সদিচ্ছা থাকে এবং তারা আইন মেনে কাজ করতে চান তবে, যোগ্যদেরই ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যোগ্যতার পাশাপাশি হলফনামায় উল্লেখ করা প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস প্রকাশ করাও আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হতে পারে।

আইনে সব ধরনের অংশীজনদের প্রতিনিধিদের নিয়ে সার্চ কমিটি তৈরি করে তার মাধ্যমে ইসি সদস্য নিয়োগের কথা বলা থাকতে পারে। সার্চ কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ দেওয়া একজন, বিরোধীদলীয় নেতার নিয়োগ দেওয়া একজন বা সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের নিয়োগ দেওয়া একজন করে থাকতে পারে। যদিও আমাদের বর্তমান সংসদের অধিকাংশ সদস্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি হয়তো সার্চ কমিটির প্রধান হতে পারেন। সেখানে নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম থেকেও প্রতিনিধি থাকতে পারেন। কম্পট্রোলার বা অডিটর-জেনারেলকেও কমিটিতে রাখা যেতে পারে। কমিটির কাজ স্বচ্ছ হতে হবে। কমিটির সভার কার্যবিবরণী ও তাদের আলোচনার বিষয়গুলো লেখা থাকবে এবং তা প্রকাশ করতে হবে।

আগে প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়োগ দিতেন। ২০১১ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন। এটা কীভাবে গঠিত হয়? সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে আপনি দেখবেন যে, কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতির অন্য সব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার উল্লেখ আছে। সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে, রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয়। সুতরাং, সার্চ কমিটির সদস্য কে হবেন, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীই মূলত সে সিদ্ধান্ত নেন। আবার, সেই সার্চ কমিটি কীভাবে কাজ করে এবং তারা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন সে সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই।

সার্চ কমিটির পরিবর্তে সংসদীয় বিশেষ কমিটি আরেকটি বিকল্প হতে পারে। সেখানে সংসদের বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা থাকবেন। কিন্তু, এখানে সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের সংসদ প্রতিনিধিত্বশীল নয় এবং বর্তমান সংসদের সদস্যদের বেশিরভাগই জনগণের ভোটে 'নির্বাচিত' নন। আরেকটি বাস্তবতা হলো, সংসদ নির্বাহী বিভাগের অনুগত হয়ে গেছে। তাই আমি মনে করি না যে এ ধরনের কমিটি এখানে কাজ করবে।

আমাদের সংবিধান প্রণয়নকারীরা হয়তো কখনো ভাবেননি যে, এমন দিন আসবে যখন ক্ষমতাসীনরা ইসি সদস্য ঠিক করে দেবে। যারা জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে তাদের নিজেদের স্বার্থে কাজ করবে। আমি সংবিধান প্রণয়নকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানান, ইসিতে মর্যাদাসম্পন্ন ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হবে বলেই তারা ভেবেছিলেন, যারা নির্বাচনকে কলঙ্কিত হতে দেবেন না। তারা ভাবেননি যে, বর্তমান সময়ের মতো কার্যত একদলীয় সরকার কখনো আসবে।

ডেইলি স্টার: সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোয় ভোটারদের উপস্থিতি যখন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এ অবস্থায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অবদানকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

বদিউল আলম: বর্তমান নির্বাচন কমিশন শুধু আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষতিই করেনি বরং তাদের বিরুদ্ধে দলীয় পক্ষপাতমূলক আচরণের গুরুতর অভিযোগও আছে। এই প্রথম এমন একটি সংস্থা ও তার প্রধানের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিএনপির সময় যুগ্মসচিব ছিলেন এবং সে সময় তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে আবার চাকরিতে বহাল করে। সুতরাং, তার পক্ষে একটা দলের বিরুদ্ধে নেতিবাচক অবস্থান নেওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।

একটা বিষয় মনে আছে নিশ্চয় যে, সিইসি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সম্পর্কে বলেছিলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে সেগুলো ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু, সব বিরোধী দল ইভিএমের বিরোধিতা করলেও, তিনি তার কথা রাখেননি। তিনি ইভিএম ব্যবহার করেন। আমরা যে ইভিএমগুলো কিনেছি সেখানে পেপার ট্রেইল (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) নেই। এতে কারচুপির সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। এ ছাড়া, ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে সেগুলো কিনেছে বাংলাদেশ। ('ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম', ১৬ অক্টোবর ২০১৮, প্রথম আলো)। যখন আমাদের ইভিএম কেনা হয়, তখন একটি কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পেপার ট্রেইল না থাকায় কমিটির প্রধান প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এই ইভিএমগুলো কেনার অনুমোদন দিতে রাজি হননি।

ভারতেও প্রথমে ইভিএমে পেপার ট্রেইল ছিল না। পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে পেপার ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (ভোটার ভ্যারিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল) যোগ করতে নির্দেশ দেন। দেশটির নির্বাচন কমিশনকে পরে তাদের ইভিএম যন্ত্রগুলো পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বাংলাদেশও তা করতে পারত।

কিন্তু, আমাদের ইভিএম সরাসরি ইসির নিয়ন্ত্রণে। তাদের প্রকাশ করা নির্বাচনী ফলাফলগুলো যাচাই করার কোনো উপায় নেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফলাফল হেরফেরের একটি উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। সেখানে অন্তত ২ বার ফল ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি নিজেও এটা নিয়ে লিখেছি। ইভিএমে ২ বার ফল প্রকাশের সুযোগ থাকার কথা নয়।

সেখানে যেটা হয়েছিল তা হলো, নির্বাচনের রাতে প্রকাশিত ফলাফলে দেখানো হয় বিএনপির প্রার্থী ২২টি কেন্দ্রে কোনো ভোট পাননি। তাই, তারা দ্বিতীয় বার ফল প্রকাশ করে। এমনকি, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন, আমি বিভিন্ন কেন্দ্রের নির্বাচনের ফলাফল পেতে চেয়েছিলাম। আগেও ইসি কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করত। কিন্তু, বর্তমান ইসি সেগুলো প্রকাশ করেনি। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলার এবং তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা শোনেনি। তাই আমি তথ্য অধিকার আইনে একটি আবেদন জমা দেই। অবশেষে, অনেক কালক্ষেপণের পর তারা তাদের ওয়েবসাইটে সেগুলো প্রকাশ করে। যখন আমরা কেন্দ্রভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করলাম, তখন আমরা দেখলাম ৪০ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে ২১৩টিতে শতভাগ ভোট পড়েছে। এটা সম্ভব নয়, কারণ নির্বাচনের অনেক আগে ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তালিকায় অনেকেই ছিলেন যারা মারা গেছেন, দেশের বাইরে ছিলেন বা জেলে ছিলেন। শুধু তাই নয়, ফলাফলে চট্টগ্রামের একজন প্রার্থী শূন্য ভোট পেয়েছিলেন বলেও দেখা গিয়েছিল। যদিও পরে তা পরিবর্তন করা হয়। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে কোনো ভোট পায়নি। এমনকি ২টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগও কোনো ভোট পায়নি।

এটা দুঃখজনক যে বর্তমান সিইসি ও অপর ৩ নির্বাচন কমিশনার এমন সব কাজ করেছেন অনেকের কাছে যা ছিল খুবই অসম্মানজনক এবং আমার দৃষ্টিতে জনস্বার্থে সে সব করা হয়নি। আসলে আমি বলব, এটা আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন কমিশন।

এ বিষয়টা বোঝাতে বলছি, বর্তমান কমিশনাররা নিজেদের জন্য ১৫টি বিশেষ পদ তৈরি করেছেন। যেমন বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা, কোর্স পরিচালক, কোর্স সমন্বয়কারী ও সহকারী কোর্স সমন্বয়কারী প্রভৃতি। এসব কাজ করার জন্যই তাদের নিয়োগ দেওয়া হলেও এগুলোর জন্য তাদের আলাদা করে টাকা দিতে হয়েছে। আগের নির্বাচন কমিশনাররা এসব কাজ করলেও এর জন্য কখনো অতিরিক্ত টাকা নেননি। বৈশাখী টেলিভিশন এই অনিয়মগুলো অনুসন্ধান করে ৭ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচার করেছে। আমিসহ দেশের ৪৪ জন নাগরিক এ বিষয়ে তদন্ত চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ২টি চিঠি দিয়েছিলাম। আমরা আমাদের অভিযোগের সমর্থনে সুনির্দিষ্ট তথ্যও দিয়েছিলাম। যদিও সেগুলো আমাদের প্রমাণ করতে হয়নি। কিন্তু, রাষ্ট্রপতি আমাদের চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত করেননি।

যা হোক, ইসি একা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না, সেটাই আমি বলব। যদি সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা যেমন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আমলাতন্ত্র অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে, ইসি শক্তিশালী হলেও অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু এটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ঠেকাতে পারে।

আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার রায়ে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির 'আইনি বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনেরও ক্ষমতা আছে'। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ইসির ক্ষমতা সীমাহীন। ইসির যদি মনে হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না, তবে তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে, কিংবা তদন্ত করে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করতে পারে। কিন্তু, এই ইসি কিছুই করেনি। এমনকি যখন ড. কামাল হোসেন এবং অন্যান্য বিরোধী নেতাদের ওপর হামলা হয়েছিল, তখনও এরা কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।

ডেইলি স্টার: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আওয়ামী লীগ কি শেষ পর্যন্ত ইসি গঠনে আইন তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পথ দেখাতে পারে না? এটা না করার পেছনে কোন কারণ থাকতে পারে?

বদিউল আলম: আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আমাদের সংবিধানের মূলনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। গণতন্ত্র তার মধ্যে একটা। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র'। ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, স্থানীয় স্তরের সব প্রশাসনিক ইউনিটে জনগণের শাসন নিশ্চিত করা হবে। আমরা এসব প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গেছি। যদিও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের আত্মনির্ধারণের অধিকারসহ এসব আদর্শের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।

আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, 'রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। যেখানে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে এবং সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষিত হবে।' এ কারণেই আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি। রাষ্ট্র এখন আর জনস্বার্থে পরিচালিত হয় না বরং, পরিচালিত হয় গোষ্ঠীস্বার্থে। ওই নীতিগুলোকে মাথায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয় না। বরং যে ক্ষমতায় থাকে, তার ক্ষমতা বজায় রাখতে এটা করে না।

জাতি হিসেবে আমরা বর্তমানে একটি বিপজ্জনক বাঁকে অবস্থান করছি। মানুষ ভীষণ অসন্তুষ্ট ও অখুশি। এতে আমাদের তরুণদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৌলবাদের দিকে ধাবিত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, যখন আমি শুনি যে, কিছু লোক তালেবানসহ এ ধরনের মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে, আমি সত্যিই অবাক হই না। যদিও আমি এদেরকে ঘৃণা করি। তবে, এটি আমাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। যখন মানুষ হতাশ ও অসন্তুষ্ট থাকে এবং তারা কোনো উপায় খুঁজে পায় না, তখন তারা ধর্মভিত্তিক সমাধান খুঁজতে বা চরমপন্থা গ্রহণ করে, যা কারো জন্যই মঙ্গলজনক না। তাই আমার প্রার্থনা ও আশা এই যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো প্রজ্ঞাবান। তিনি তার সময়ে এমন কিছু রেখে যাবেন যা নিয়ে তিনি পরে গর্ব করবেন, যা নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করতে পারব।

ডেইলি স্টার: সার্চ কমিটি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক অবস্থান নিয়ে আপনার মতামত কী?

বদিউল আলম: ক্ষমতাসীন দল বলছে, একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠিত হবে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, 'সার্চ কমিটিও আইনের কাছাকাছি এবং একটা আইন প্রণয়নের মতো সময় নেই।' আমি বিষয়টা বুঝতে পারিনি। প্রথমত, যখন বলা হয় সার্চ কমিটি আইনের কাছাকাছি, তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, কতটা কাছাকাছি? হয় এটি আইন কিংবা আইন নয়। সময় নেই বলে দাবি করারও কোনো মানে হয় না। ক্ষমতাসীন দল ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে এবং আইনমন্ত্রী নিজেও বেশ কয়েক বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাহলে এত সময় ধরে তারা কী করছেন? এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ ছাড়া, ৩ থেকে ৪ পৃষ্ঠার একটা সহজ আইন তৈরি করতে বেশি সময় লাগার কথা না।

ড. শামসুল হুদা কমিশন ২০১১ সালে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছিল। সেই খসড়া ও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে একটি খসড়া প্রস্তুত করেছি। সুতরাং, আইনের একটি খসড়া দ্রুত তৈরি করে মতামতের জন্য জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করা যেতে পারে। এখনো কয়েক মাস বাকি আছে। সুতরাং, তাদের এই অজুহাতের কোনো মানে হয় না। আমরা ইতোমধ্যে দেখিয়েছি যে, এটি করা সম্ভব এবং আমরা সাহায্য করতেও আগ্রহী।

আরেকটি কথা, ক্ষমতাসীন দল বলে যে, তারা সংবিধান মেনে চলতে চায়। ঠিক আছে, নির্বাচনকালীন সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা সংবিধানে নেই এবং তারা এটা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। আমার ভিন্ন মত থাকলেও, আমরা সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু, সার্চ কমিটির কথাও সংবিধানে নেই। তারা মূলত সংবিধান থেকে যেটা তাদের জন্য সুবিধাজনক, সেটা গ্রহণ করে। তারা তাদের স্বার্থে সংবিধান ব্যবহার করছে। সংবিধানে স্বার্থপরিপন্থী কিছু থাকলে, তারা সেটা এড়িয়ে চলে।

২০১১ সালে সিনিয়র সংসদ সদস্য সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করেন। কমিটির বৈঠকে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, 'আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেজর কোনো কিছুতে হাত দেওয়া আমাদের কোনোমতেই উচিত হবে না।... যদি ২ টার্মের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে ওই ২ টার্মের পর হয়তো আমাদের ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। তখন আমাদের চিৎকার করতে হবে... এই সময়ের মধ্যে আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে না।' ('কোন সংবিধান, কার সংবিধান' ২৮ অক্টোবর ২০১৩, প্রথম আলো)

আমির হোসেন আমু বলেছিলেন, 'আসলে আমরা যদি এটা পরিবর্তন করতে যাই, তাহলে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হবে, অনেক ঝামেলার মধ্যে আমরা জড়িয়ে পড়ব। তার চেয়ে ভালো এটা যেভাবে আছে, সেভাবে থাক।'

সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছিলেন, 'আমরা যখন প্রথম বৈঠকে বসি, তখন কতগুলো নীতিমালা নিয়েছিলাম যে, আমরা এমন কোনো বিষয়ে যাব না, যাতে বিতর্কে জড়িয়ে যাই। আমরা বিতর্কিত কোনো বিষয়ে হাত দেব না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ব্যবস্থা আছে, এটাই থাকুক।' শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছিলেন, 'আমিও একমত যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আমাদের কোনো পরিবর্তন এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই।'

প্রয়াত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, 'সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এটাকে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) রেখেই আগানো ভালো।'

কমিটি 'সর্বসম্মতিক্রমে' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করে এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। পরিবর্তন পরে হয়। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকেরা একটি সংক্ষিপ্ত আদেশে জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সংসদের অনুমতি সাপেক্ষে এই ব্যবস্থাকে আরও ২ টার্মের জন্য রাখার পক্ষে পর্যবেক্ষণ দেন। তবে, যে পদ্ধতিতে সংশোধনী আনা হয়েছিল তা অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছিল যা এখনো জনমনে রয়ে গেছে।

অনুবাদ করেছেন শরীফ এম শফিক

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago