পাবনায় ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন হয় ১৯৪৮ সালে

রণেশ মৈত্র, আমিনুল ইসলাম বাদশা এবং লুতফর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য প্রাণ দেন সালাম, বরকত, রফিক জব্বারসহ অনেকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে যখন রক্তের বন্যা বইছে তখন সে উত্তাপ ছড়িয়ে পরে পাবনার বুকেও।

রেডিওতে খবরটি শুনে পাবনার ছাত্র-জনতা পরদিন নেমে আসেন রাজপথে। ঢাকায় হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিক্ষোভ সমাবেশ চলে।

ভাষার জন্য পাবনার মানুষের এ বিক্ষোভ হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি। এর বীজ বপন হয় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। এরপর পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে সে বিক্ষোভ গণআন্দোলনের রূপ নেয় পাবনায়।

ওই ঘটনার পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাবনার মুসলিম লীগ নেতা দেওয়ান লুতফর রহমানের বাসায় এক বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীরা। ২৭ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হল মাঠে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

প্রতিবাদ সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে। গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। দেওয়ান লুতফর রহমানকে আহ্বায়ক করে তৎকালীন বামপন্থী নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা এবং মাহাবুবুর রহমান খানকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পাবনায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ভাষা আন্দোলন।

২৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাবনায় হরতাল আহ্বান করে সংগ্রাম পরিষদ। আন্দোলনকারীদের দমন করতে পাবনা জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা দেয়। ১৪৪ ধারা ভেঙে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। মুহূর্তেই বিক্ষোভ মিছিলটি গণমিছিলের রূপ নেয়।

মিছিলটি শহরের দিকে এগুতেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ প্রায় ৪০ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃতদের জেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা এক জোট হয়ে পাবনা জেলখানার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। তাদের মুক্ত না করা পর্যন্ত জেলগেটে অবস্থান করেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভের মুখে সন্ধ্যায় গ্রেপ্তারকৃতদের সবাইকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। দিনভর স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়।

৫২ সালে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে যখন ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলন চলছে, তখন পাবনার ৪৮'র ভাষা সংগ্রামীদের অনেকই ছিলেন কারারুদ্ধ। পাবনায় ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ নেয় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। অথচ প্রায় ৭ দশক পরেও পাবনার ভাষা সংগ্রামীদের অধিকাংশই পাননি কোনো স্বীকৃতি।

ভাষাসৈনিক রণেশ মৈত্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৪৮ এর আকস্মিক সংঘটিত এ আন্দোলন পরিপূর্ণতা পায় ১৯৫২ এর চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে।'

স্মৃতি থেকে ভাষার জন্য পাবনাবাসীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা মনে করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন ৫২'র ভাষাসৈনিক রণেশ মৈত্র।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রণেশ মৈত্র বলেন, '২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গুলি চালানোর খবর রেডিওতে শোনার পর বিক্ষোভে ফেটে পরে পাবনার মানুষ।'

'এ ঘটনার পরে পাবনায় সবস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, ভাষার দাবিতে রাজপথে মিছিল শুরু হয়। পুলিশ সে সময় কাউকে গ্রেপ্তার করতে সাহস পায়নি।'

তিনি বলেন, 'ভাষার জন্য পাবনার মানুষ ৪৮ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু করেন। ৪৮ এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ৫২'তে রাজপথে নামেন পাবনার বিপ্লবী জনতা। তবে ৫২'র ভাষা আন্দোলনের সময় ৪৮ এর ভাষা সংগ্রামীদের বেশিরভাগই কারাবন্দী ছিলেন।'

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরেও এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি বলে মনে করেন ভাষাসৈনিক রণেশ মৈত্র।

তিনি বলেন, '১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য নয়, ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এখনও গড়ে উঠেনি।'

আগামী প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়িত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক রণেশ মৈত্র।

Comments

The Daily Star  | English
price hike of essential commodities in Bangladesh

Essential commodities: Price spiral hits fixed-income families hard

Supply chain experts and consumer rights activists blame the absence of consistent market monitoring, dwindling supply of winter vegetables, and the end of VAT exemptions granted during Ramadan.

13h ago