‘পোলাডার লাশটা আইন্না দ্যান, এক নজর দেকমু’

'মোর পোলাডার লাশটা আইন্না দেন, মোর পোলাডারে মুই এক নজর দেকমু।' কথাগুলো বলছিলেন ইউক্রেনের বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মা আমেনা বেগম।
সন্তান হারিয়ে আজাহারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন আমেনা বেগম। তিনি বলছিলেন, 'বাপজান মোরে কইছে, এইবার বাড়িতে আইয়া ঘর উডাইবে। আর ভাঙা ঘরে থাহন লাগবে না মা। ঘরহান উডান অইলে বিয়া কইরা বউ ঘরে আনবে।'
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর ছিলেন তার পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। তিনি অবসরে গিয়েছেন প্রায় ৭ বছর আগে। মা আমেনা বেগম গৃহিনী। ৪ ভাই বোনের মধ্যে হাদিসুর দ্বিতীয়।
সবার বড় বোন সানজিদা আকতারের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে তিনি পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। ছোট ২ ভাইয়ের মধ্যে মো. তারেক পটুয়াখালী সরকারি কলেজে অনার্স ৪র্থ বর্ষে এবং গোলাম মাওলা ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত।
হাদিসুরের মরদেহ ফিরে পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি' নামের জাহাজটিতে ৭ বছর যাবৎ চাকরি করেন হাদিসুর রহমান। জাহাজ থেকে হাদিসের এক বন্ধু ফোন করে জানান, বন্দরের জলসীমায় ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আটকে রয়েছে তাদের জাহাজ। ইউক্রেন সময় বুধবার ৫টা ১০ মিনিটের দিকে তাদের জাহাজে হামলা হয়েছে। জাহাজে বাংলাদেশের ২৯ জন নাবিক রয়েছেন, এর মধ্যে হাদিস জাহাজের সামনে বাইরের অংশে অবস্থান করায় রকেট হামলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিহত হয়েছেন।
এর আগে বাংলাদেশি জাহাজটিতে হামলার খবর গণমাধ্যমকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে নিশ্চিত করেন জাহাজটিতে থাকা একজন নাবিক।
হাদিসুর রহমানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'বাড়িতে এসে ছেলের ঘরের কাজ ধরার কথা ছিল। বিয়ে করার কথা ছিল। সব শেষ হয়ে গেল। আমি অন্তত আমার ছেলের লাশটা চাই।'
নিহত হাদিসুরের ছোট ভাই মো. তারেক বলেন, 'বুধবার সকালেও মোবাইলে ভাই আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলছিলেন, আর ভাঙা ঘরে থাকতে হবে না। বাড়িতে এসে যেভাবেই হোক ঘরের কাজ ধরবেন।'
মৃত্যুর আগে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইলে এটাই ছিল হাদিসুরের শেষ কথা।
হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা বলেন, 'ভাই এভাবে মারা যাবেন তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমাদের সব স্বপ্ন শেষ।'
ভাইয়ের মরদেহটা যেন দেখতে পান সেই আকুতি করতে করতে একমাত্র বোন সানজিদার কান্নায় সেখানে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
৫ দিন আগে হাদিসুর তার মা আমেনা বেগমকে মোবাইলে জানিয়েছিলেন যুদ্ধে আটকা পড়ার কথা। তখন থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিল পরিবারটি।
হাদিসুরের চাচা বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, 'এখন দুশ্চিন্তায় আছি মরদেহ দেশে আনব কীভাবে। সকালে জেলা প্রশাসকের কাছে মরদেহ দেশে আনার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছি।'
তিনি জানান জানান, বুধবার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য নেটওয়ার্কের সিগন্যাল পেতে জাহাজের কেবিন থেকে বেরিয়ে ব্রিজে আসেন হাদিসুর। এর কিছুক্ষণ পরেই জাহাজটি লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায় রাশিয়ান সেনারা। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান হাদিসুর।
বরগুনা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, 'নিহত হাদিসুরের মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তার মরদেহটি আনার জন্য।'
হাদিসুর বেতাগী সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি এবং ২০১০ সালে বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
বেতাগী সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম কবির বলেন, 'হাদিসুর খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করতাম।'
Comments