‘হামরা চাইল ভাজা দিয়া ইফতার করি’
'চাইল ভাজা আর ভুট্টা ভাজা হইল হামরা ইফতারির খাবার। হামরা এইল্যা খ্যায়া রোজা খুলি। হামারতো আর বুট বুন্দিয়া ফলমূল কিনবার সাধ্য নাই,' কথাগুলো বলছিলেন ৩ সন্তানের মা তিস্তাপাড়ের রিনা বেগম (৩২)।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তিস্তাপাড় কালমাটি গ্রামের দিনমজুর শামসুল হকের স্ত্রী রিনা। আবাদি জমি ও বসতভিটা তিস্তায় বিলীন হওয়ায় অন্যের জমিতে ঘর তুলে বাস করছেন।
কৃষি শ্রমিক হিসেবে দেশের নানা জায়গায় কাজ করার জন্য বাড়ির বাইরে থাকেন শামসুল। রিনা বেগমই সংসার সামলান। বড় ছেলে রমজান আলী সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, মেয়ে সামিনা খাতুন চতুর্থ শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে হৃদয় বাবুর বয়স ৪ বছর।
দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে রোজা রাখেন রিনা। বলেন, ছেলেমেয়েরা ইফতারিতে ভালো খাবার চায়। কিন্তু চাল ভাজাই ভরসা।
'হামার ছওয়াগুলা বাহারি ইফতার খাবার চায় কিন্তু মুই কোনটে পাঙ। মোর হাতোত তো আর টাকা নাই। ছওয়াগুলাক বুঝিশুনি কয়া চাল ভাজা তিবার নাইকছোঙ।'
তিনি বলেন, 'ছওয়াগুলা যখন কান্দে তখন খুব খারাপ নাগে। রাগও হোঙ। আড়ালোত ফির মুইও কান্দোঙ।'
কথা হয় রিনা বেগমের বড় ছেলে রমজান আলীর (১৩) সঙ্গে।
বলে, প্রতিদিন চাল ভাজা দিয়ে ইফতার করতে ইচ্ছে করে না। অনেকে পেঁয়াজু, ফলমুল দিয়ে ইফতার করে।
'আব্বাক কইছোং হামাক যেনো টাকা পাঠায়।'
'চাল ভাজা' আর 'ভুট্টা ভাজা' লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের তিস্তা নদীর তীরবর্তী ও চর এলাকাগুলোর রোজকার ইফতারের খাবার। ইফতারের জন্য বাহারি খাবার কেনার সামর্থ্য না থাকায় তারা এগুলোই খান।
পবিত্র রমজান মাসে ইফতারে খাওয়ার জন্য তিস্তাপাড়ের অধিকাংশ পরিবারের লোকজনকে 'চাল ভাজা' এবং 'ভুট্টা ভাজা' তৈরি করতে দেখা যায়।
তিস্তাপাড় কালমাটি গ্রামের সহিদ মিয়া (৬৮) ডেইলি স্টারকে বলেন, তিস্তাপাড়ের মানুষ আগে থেকে চাল ভাজা ও ভুট্টা ভাজা দিয়ে ইফতার করতে অভ্যস্থ। যাদের সামর্থ্য আছে তারা বাজার থেকে বাহারি ইফতার কিনে আনেন। 'ম্যালা দিন থাকি রমজান মাসে চাইল ভাজা ভুট্টা ভাজা খ্যায়া তিক্ত হয়া গ্যাইছোং। এইল্যা আর খাবার মনায় না। কিন্তু কোনো উপায় নাই। মুই এ্যালা কাজ করির পাং না। ব্যাটা কামলা দিয়া যেইকনা কামাই করে তাক দিয়া সংসার চালায়,' তিনি বলেন।
'হামমার ১৩ বিঘা আবাদি জমি তিস্তার প্যাটোত পড়ি আছে। মাইনসের জমিত বাড়ি করি থাইকবার নাগছি,' তিনি বলেন।
'হামারগুলার ভাগ্যোত ভালো ইফতারও জোটে না আর সেহরির সময় ভালো খাবারও জোটে না। আল্লাহ হামাক গরিব বানাইছে এ্যালা কি কইরমো। হামরাগুলি বুঝি কিন্তু হামার ছওয়া পোয়গুলা বুইঝবার চায় না,' জানান তিস্তাপাড় কামলমাটি গ্রামের দুই সন্তানের জননী শরিফা বেগম (২৮)।
'আশা করি আছোং শ্যাষের রোজার দিন ছওয়াগুলাক দামি ইফতার কিনি আনি খাওয়াইম,' তিনি বলেন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তাপাড়ের ইউনিয়ন রাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, তিস্তাপাড়ের অনেক মানুষ চাল ভাজা, ভুট্টা ভাজাকে ইফতারে খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন এবং খুব কম লোকই ঐতিহ্যবাহী ইফতার আইটেম কিনতে পারেন।
Comments