মুক্তিযুদ্ধ

৩০ জুলাই ১৯৭১: শরণার্থীর সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালত অভিনেত্রী কবরী, কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারকে ১৩ আগস্টের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে ১৬ আগস্টের মধ্যে ছাত্রনেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আনাম খান খসরু ও আব্দুল গণি মনুকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাজিরা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্য অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালত অভিনেত্রী কবরী, কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারকে ১৩ আগস্টের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে ১৬ আগস্টের মধ্যে ছাত্রনেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আনাম খান খসরু ও আব্দুল গণি মনুকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাজিরা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্য অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
ঢাকায় এদিন
৩০ জুলাই ঢাকায় সামরিক আদালত মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অংশগ্রহণকারী ১৩ জন তরুণকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা হচ্ছেন চাঁদপুরের মোহাম্মদ ইদ্রিস, কুমিল্লার দাউদকান্দির আব্দুল ওহাব, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আব্দুর রহমান, সেনবাগের ভুলু, কুমিল্লার দেবীদ্বারের মুজিবুর রহমান ও ঢাকার রায়পুরার কালুগাজী, শফি, কাফী, সাদী, মান্নান, বারেক, খালেক ও শরাফত। আদালত জানায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাজিরা না দিলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্য শুরু হবে।
ভারতে এদিন 
৩০ জুলাই রাজ্যসভায় ভারতের শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর বলেন, 'এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৬০ কোটি রুপি খরচ হয়ে গেছে। আমাদের এখনো অর্থ দরকার। এই পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ৭০ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ জনে পৌঁছেছে।'
৩০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, শরণার্থী শিবিরগুলো দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত বিদেশিদের বদলে এখন সেখানে ভারতীয়দের নিযুক্ত করা হচ্ছে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার ২৬ জন প্রতিনিধিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা চলে যাওয়ার নোটিশ দিয়েছি।
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
৩০ জুলাই মার্কিন সিনেটে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর মন্ডেল ও ফ্রেজার যৌথ প্রস্তাবে বলেন, 'প্রেসিডেন্ট, ব্যাপক মৃত্যু ও দুঃখ-দুর্দশার এই বিশ্বে পূর্ব-পাকিস্তানের এই ভীতিকর পরিস্থিতির কোনো সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় না। শত হাজার মানুষ রোগ, অনাহার ও সামরিক বাহিনীর পাশবিক নিপীড়নে মৃত্যুবরণ করেছে। এখন প্রায় ৭০ লাখেরও অধিক মানুষ চরম হতাশায় ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমেরিকার জনগণ এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির একটা বিশেষ ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরেছে, আর তা হচ্ছে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রতি আমাদের সরকারের অযৌক্তিক অবহেলা। মিথ্যা বর্ণনা আর অসার প্রতিশ্রুতি যা যুক্তরাষ্ট্র করে এসেছে যখন তারা পূর্ব পাকিস্তানের দমনমূলক সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করছিল আর লক্ষাধিক মানুষ নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও তারা নির্মম নীরবতা বজায় রেখেছিল।'
৩০ জুলাই সাবেক মার্কিন সিনেটর ইউজিন ম্যাককার্থি লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'আমি স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন করি। ভৌগলিক কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্য। যুগের পর যুগ করে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব বাংলার মানুষের উপর নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছে।'
এর আগে ২৯ জুলাই সাবেক ইউজিন ম্যাককার্থি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির আমন্ত্রণে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দিতে লন্ডনে আসেন। 
৩০ জুলাই মার্কিন সিনেট অধিবেশনে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর পিয়ারসন এক বক্তৃতায় বলেন, 'আমেরিকানদের জন্য হাজার হাজার মানুষের অনাহারে অকারণ বীভৎস মৃত্যুর মাঝে চুপচাপ বসে থাকা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানে অনাহারে মানুষের অনর্থক মৃত্যু আমেরিকার জনগণের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে, সম্ভবত যার প্রভাব দৃষ্টি আকর্ষক বাইজেন্টাইনের চেয়েও বেশি। মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কি পাকিস্তানের জনগণকে এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ হওয়া উচিত যে আমেরিকার অনেক মানুষ এই অপ্রয়োজনীয় অনাহার ও মানুষের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞকে উপেক্ষা করতে পারছে না? কংগ্রেস, আইনসঙ্গতভাবেই, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ করতে পারে।' 
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
৩০ জুলাই প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র 'ওয়াশিংটন পোস্ট' এ এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'পাকিস্তানে হিটলারের পরে সংগঠিত হওয়া সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হচ্ছে – আজকের বিশ্ব। হলোকাস্টের ফলে যখন শত সহস্র লোক মারা গেছে এবং কোটি লোক পালিয়ে গেছে, তখন পৃথিবী এসব আতঙ্কের দিকে শুধু তাকিয়েই দেখেছে তাদের জন্য করেছে সামান্যই। এই বেদনাদায়ক ঘটনাসমূহের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং বেঁচে থাকা লোকদের জন্য ভিক্ষা প্রদান করতে চেয়েছে পাশাপাশি তারা পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় বাহিনীকেও দায়ী করেছে।' 
৩০ জুলাই ভারতের 'দ্য স্টেটসম্যান' পত্রিকায় একটি বিশেষ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয় 'নয়াদিল্লী একটি বিষয়ে খুবই সজাগ, আর তা হলো বাংলাদেশ বিষয়টি যেন কোনোভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি বিষয় না হয়। ইসলামাবাদ যখন দাবি করেছিল যে, বাংলাদেশের সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তখন বিশ্বমানবতার উচিত ছিল হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। লাখ লাখ উদ্বাস্তু যখন ভারত আসছিল তখন এটা আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। ভারত এটাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মেনে নিতে নারাজ। আশা করা হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেবে এবং পাকিস্তানকে থামাতে চেষ্টা করবে। এটা শুধু মানবতার দিক থেকেই নয় পার্শবর্তী দেশের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের প্রতি হুমকি। পাকিস্তান ও তার বন্ধু দেশগুলো এখন বাংলাদেশ বিষয়কে তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক প্রভাব ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন।
৩০ জুলাই প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান 'পূর্ববঙ্গে গণহত্যা শিরোনামে' একটি আধা পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন ছাপে। সেই বিজ্ঞাপনে ঢাকার রাস্তায় তিন তরুণের লাশের নিচে একটি ছবিতে লেখা ছিল, 'ছবিটি আপনার সন্তানদের দেখান এবং তাদেরকে নিয়ে পহেলা আগস্টের জনসমাবেশে যোগ দিন।' একই সঙ্গে যারা সমাবেশে আসতে পারবে না তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সহায়তার আবেদন জানানো হয়। 
দেশব্যাপী এদিন 
৩০ জুলাই সিলেট রেজিস্টার ময়দানে ড. আবদুল মজিদের সভাপতিত্বে রাজাকারদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন ফুলতলির মাওলানা আব্দুল লতিফ, সাবেক মন্ত্রী আজমল আলী চৌধুরী প্রমুখ। সভা শেষে রাজাকাররা কুচকাওয়াজ করে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 
৩০ জুলাই চৌদ্দগ্রামের নারাণকরায় সেকেন্ড লেফটেনেন্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৯তম বেলুচ রেজিমেন্টের 'সি' কোম্পানির একটি জিপের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৬ সৈন্য নিহত হয়। হানাদার বাহিনীর জিপ থেকে আহত অবস্থায় চালককে আটক করে মুক্তিবাহিনী। পরে জিপে থাকা হানাদার বাহিনীর সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনী নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে।
৩০ জুলাই কুমিল্লার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অংশে হানাদারদের কয়েকটি অবস্থানে মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশ করে। এসময় বহু হানাদার বাহিনীর নিহত হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর হামলার মধ্যে একটি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শ্রীমান্তপুরে ঘাঁটিতে হামলায়। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় সকালে ১১ জন হানাদার সেনা নিহত হয়েছিল। সন্ধ্যায় একই জায়গায় মুক্তিবাহিনীর হামলায় চার হানাদার সেনা নিহত হয়। এদিন দুপুরে কোটেশ্বর ও রাচিয়াতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এই দুই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর যথাক্রমে ৪ সৈন্য নিহত ও ২ জন আহত হয়। এদিন বেলা ১১টার দিকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আনন্দপুরে অ্যামবুশ করে, এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ১২ সৈন্য নিহত হয়। পৃথক আরেক অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনীর হামলায় ১৮ হানাদার সেনা নিহত হয়।
৩০ জুলাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হয়।
৩০ জুলাই মুক্তিবাহিনীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ লাইনে সরবরাহকারী বৈদ্যুতিক গ্রিডের দুটি পোল ধ্বংস করে। এর ফলে আশুগঞ্জ-ঢাকা বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
এদিন মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভৈরব-নরসিংদী-ঘোড়াশাল বাইপাস হয়ে কাজ করা আশুগঞ্জ-ঢাকা লাইনের ১০০০ কিলোওয়াট গ্রিড উড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল ভৈরব-ঢাকা টেলিফোন লাইনের দুটি করে মোট ৪টি পোল ডিনামাইট মেরে উড়িয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র- 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান, ৩১ জুলাই ১৯৭১
দ্যা স্টেটসম্যান ৩০ জুলাই ১৯৭১
ওয়াশিংটন পোস্ট ৩০ জুলাই ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

 

Comments

The Daily Star  | English

Phase 2 UZ Polls: AL working to contain feuds, increase turnout

Shifting focus from its earlier position to keep relatives of its lawmakers from the upazila election, the ruling Awami League now seeks to minimise internal feuds centering on the polls and increase the voter turnout.

8h ago